আপন দর্পণ

যা করব ভাবি, তা করতে জীবন বাজি রাখি

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শরীফ খান

শরীফ খান, ছবি :: কবির হোসেন

প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় আলোচিত ব্যক্তিত্ব শরীফ খান। জন্ম ১৯৫৩ সালের ৭ এপ্রিল, বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামে। পড়াশোনা বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে (১৯৬৮-৭৪), বিষয় বাংলা। দূর শৈশব থেকে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সংশ্রব। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের পাখি বইয়ের জন্যে পান প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার। ২০১৩ সালে পান জাতীয় পরিবেশ পদক। ২০১৫ সালে পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে অবদান রাখার জন্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭১।
 
শৈশবের প্রথম স্মৃতি–

আমার গ্রামে তখন জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছিল গোলপাতা বা শণের ছাউনি দেওয়া, বাঁশ বা পাটকাঠির বেড়া, মাটির ডোয়া। নিবিড় ঘন গ্রামীণ বন ছিল চারপাশ জোড়া। তখন মনে হতো– এখনও মনে হয়, আমরা ছিলাম গভীর বনে বসবাসকারী গুটিকয় আদিবাসী মানুষ। আদিম আদিম গন্ধ যেন ভেসে বেড়াত বাতাসে। আমাদের ঘরটুকু বাদে উঠোন- বাগানজোড়া ছিল কত রকমের যে বড় বড় গাছ। নারকেল-সুপারি গাছের জন্য উঠোনে রোদ পড়ত না। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে ছিল শিয়াল-ভোঁদড়-শজারু ও খাটাশের স্থায়ী আস্তানা। গ্রামের দশটি পয়েন্টে ছিল শকুনের স্থায়ী আস্তানা। মাঠে ছিল খেকশিয়াল ও বুনো খরগোশ। ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙত কমপক্ষে ৫০ প্রজাতির পাখির ডাক ও গানে। উঠোনের গাছ ও বাগানে কত রকমের পাখি যে দেখতাম! দেখতাম ওদের বাসা- ডিম ও ছানা। দিনরাত পাখির আনাগোনা ছিল বাড়ির আঙিনার গাছগুলোতে। ওগুলো আমাকে আকর্ষণ করত প্রবলভাবে।

যে ঘটনার প্রভাব আপনাকে পাখির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট করেছে–

ফুল-পাখি-প্রজাপতিসহ প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি আকর্ষণটা আমার জন্মসূত্রে পাওয়া। শৈশব-কৈশোরে যে আকর্ষণ আমার ভেতরে ছিল, সেটা এই ৭১ বছর বয়সেও একটুও কমেনি বরং বেড়েছে বহুগুণে। পাখির পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকতে থাকতে স্কুল-কলেজ কামাই করে পাখিদের বাসা বানানো ও ছানাদের খাওয়ানোর দৃশ্য দেখাটা আমার কাছে ছিল প্রবল নেশা। দুর্নিবার এই নেশার জন্য আমার লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বাগানে আমার মা আমাকে রাঙা হালতির ডিম-বাসা ও কুচকুচে কালো ছানা দেখিয়েছিলেন– দাদি ধরে দিয়েছিলেন হালতির রংচঙা ছানা। ওই দুই প্রজাতির ছানার সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে ফেলেছিল। ওই শৈশবেই একটি সাদা বা অ্যালবিনো শিয়ালছানাকে কুকুরছানা ভেবে পুষতে চেষ্টা করেছিলাম। সে অনেক কথা।
প্রকৃতি বা পাখি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের ভেতর যাঁদের অবদান স্মরণীয় ও অনুসরণীয় মনে করেন–
ভারতের সলীম আলী, বাংলাদেশের অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেনসহ আরও দু-একজন। বর্তমানের দু-একজন প্রাণিবিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা খুব ভালো কাজ করছেন।

এ মুহূর্তে কী নিয়ে কাজ করছেন?

বাংলাদেশের স্তন্যপায়ী বন্য ও অন্যান্য প্রাণী এবং পাখি নিয়ে নিজের চোখে দেখা ওদের জীবনচক্র তথা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় বড় লেখা লিখছি। আশা করা যায় কয়েক খণ্ডে বইগুলো প্রকাশিত হবে।

পাখি ও প্রকৃতিকে ঘিরে আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

আমাদের ফকিরহাট এলাকায় দুটি উল্লেখযোগ্য পাখি হলো– হালতি ও রাঙা হালতি। এই দুই প্রজাতির পাখির বাসা-ডিম-ছানা ফকিরহাট অঞ্চল ছাড়া দেশের অন্য কোথাও আজ (মার্চ ২০২৩) পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই দুই প্রজাতিসহ আরও কয়েক প্রজাতির পাখি সংরক্ষণে নীরবে কাজ করছি সেই নব্বইয়ের দশক থেকে, এই কাজটার পরিসর বাড়ানোর জন্য কাজ করছি আমি ও আমরা।

প্রিয় লেখক যাঁরা, যে কারণে প্রিয়–

দেখুন, আমার মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আমার বয়সের সমান– ৭১। এর ভেতর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের। কিন্তু পাখির ডানার তলায় সেগুলো প্রায় ঢাকা পড়েছে। যা হোক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শওকত আলী, সেলিনা হোসেনসহ অনেকেই আছেন এই তালিকায়।

প্রিয় বই এবং যে বইগুলো বারবার পড়েন–

সবচেয়ে পছন্দের বই ‘আরণ্যক’। তারপর বিখ্যাত বাঘশিকারি জিম করবেটের শিকার কাহিনির বইগুলো। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’সহ আরও কিছু বই। পাঠক হিসেবে আমি খুবই ভালো। জাতীয় পত্রপত্রিকা ও মাসিক পত্রিকার সব গল্প-কবিতা, ছড়া (সাহিত্য ও শিশুকিশোর পাতাসহ) আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ি।

জীবনে আরও যা হতে পারতেন–

ক্রিকেটার। ফাস্ট বোলার আমি হতে পারতামই। ছাত্রজীবনে প্রচুর ক্রিকেট খেলেছি। ১৯৬৯ সালে আমাদের গ্রামের মাঠে খুলনা থেকে খেলতে এসেছিল ‘বোম্বাইয়া ক্রিকেট ক্লাব’। আমরা হেরে যাই। কিন্তু আমি নিজে ছয়টি উইকেট নিয়েছিলাম। বাগেরহাটের পিসি কলেজে পড়ার সময় কলেজ টিমেও খেলেছি।

ব্যক্তিগত যে সীমাবদ্ধতা আপনাকে কষ্ট দেয়–

আমি অতিশয় সহনশীল ও নরম-কোমল মনের মানুষ। সব সময় আমি টেনশন-ফ্রি থাকতে চাই। প্রায় সময়ই আমি নিজের মনের ভুবনে বিচরণ করি, গতানুগতিক কাজ আমার ভালো লাগে না। এজন্য ভুল বোঝাবুঝি হয়।

আপনার চরিত্রের শক্তিশালী দিক–

সততা। আশাবাদী মানুষ আমি। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারি। ইচ্ছাশক্তি আমার অতিশয় প্রবল। যেটা আমি করব ভাবি, সেটা করতে চাই জীবন বাজি রেখে। ধৈর্যহারা হই না।

প্রিয়জনের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি শোনা প্রশংসাবাক্য ও অভিযোগবাক্য–

প্রশংসাবাক্য তেমন নেই। আমি সংসার নিয়ে উদাসীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অলস, আড্ডাবাজ ইত্যাদিসহ আরও বহু অভিযোগ।

প্রিয় উদ্ধৃতি–

জিম করবেটের উক্তিটা অনেকটাই এ রকম যে, আজ পারিনি, তাতে কী! কালকের দিনটা তো আমার হাতে আছেই। তা না হলেও পরশু তো পারবই।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com