নববর্ষ ১৪৩০

নববর্ষ উদযাপন

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২৩ । ১০:০৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

আবুল কাসেম ফজলুল হক

ঢাকা শহরে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো না। আগেকার জেলা শহর ও মহকুমা শহরগুলোতেও তা হতো না। গ্রামাঞ্চলে কৃষিজীবীদের মধ্যে বাংলা সন-তারিখের প্রচলন ছিল। ফসল বোনার ও ফসল তোলার সময় বাংলা সন-তারিখ দিয়ে নির্ধারণ করা হতো। মাসে তেরো পার্বণের তারিখও বাংলা সন দিয়ে নির্ধারণ করা হতো। মুসলমানদের অনুষ্ঠানাদি হিজরি সন-তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত হতো রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রিক সবখানে ব্যবহৃত হয় খ্রিষ্টীয় সন-তারিখ। রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রিকভাবে বাংলা সন-তারিখ ব্যবহারের চিন্তা ও চেষ্টা ঠিক নয়।

গ্রামের ও শহরের জীবনধারায় ভিন্নতা ছিল, আছে। শহুরে লোকেরা গ্রামের লোকদের পশ্চাৎবর্তী সংস্কৃতির লোক মনে করত। তখন শিক্ষিত লোকদের মধ্যে শহুরে বা নাগরিক হওয়ার তৎপরতা ছিল। কবি শামসুর রাহমানকে বলা হতো নাগরিক কবি এবং তিনি নিজেও নাগরিক পরিচয় নিয়েই চলতে চাইতেন। জসীম উদদীন অভিহিত হতেন পল্লিকবি বলে। কবি হিসেবে কলকাতায় তিনি যে মর্যাদা পেতেন, ঢাকায় তা পেতেন না।
ব্রিটিশ-শাসনকালে বাংলার গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে পহেলা বৈশাখ যেভাবে উদযাপিত হতো তাতে থাকত মেলা, হালখাতা ইত্যাদি। নির্দিষ্ট স্থানে বসত মেলা। তাতে বিন্নি খই, জিলাপি ইত্যাদি বিক্রি হতো। ছোটদের প্রিয় নানা রকম খেলনা ও জামা-কাপড়ও বিক্রি হতো। চেয়ার-টেবিল, খাট-পালঙ্ক এবং নানা রকম শৌখিন জিনিসপত্র বিক্রি হতো। মেলার পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো স্থানে জুয়া খেলা হতো। কখনও কখনও পুলিশ এসে জুয়ারিদের তাড়া করত। ছোট ছেলেমেয়েরা বাবার সঙ্গে কিংবা অন্য কোনো অভিভাবকের সঙ্গে মেলায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকত। বৈশাখী মেলা ছিল আনন্দের অনুষ্ঠান।

বাজারে যাঁদের দোকান থাকত তাঁরা বৈশাখ মাসে হালখাতা অনুষ্ঠান করতেন। তাঁরা বিগত বৎসরের আয়-ব্যয়ের যে কেবল পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হতো তা নয়। গোটা বৈশাখ মাস ধরেই বিভিন্ন দোকানি সুবিধামতো হালখাতার দিন ঠিক করতেন। হালখাতায় দোকানি তাঁর আয়-ব্যয় সম্পর্কে আমন্ত্রিত অতিথিদের অবহিত করতেন। যাঁরা বাকিতে কোনো কিছু নিয়ে থাকতেন তাঁরা দোকানিকে তাঁর পাওনা পরিশোধ করতেন। এটা ছিল হালখাতার কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নতুন বছরে ব্যবসায়ের বৎসরের সম্ভাবনা ও করণীয় বিষয়েও আলোচনা হতো। হালখাতা অনুষ্ঠানে যাঁরা আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আসতেন তাঁদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। বিগত বছর ও নতুন বছরের মাঝখানে হালখাতা হতো একটি আনন্দ-অনুষ্ঠান।

পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রেই খ্রিষ্টীয় সন-তারিখের বাইরে নিজেদের সন-তারিখ ব্যবহার করা হয় না। তা সত্ত্বেও সেসব রাষ্ট্রে নিজেদের নববর্ষ অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপন করা হয়। নিজেদের জাতীয় চেতনাকে দৃঢ়তর করার ও সমৃদ্ধতর জীবনবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই এটা করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রেও বাংলা নববর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্য একই রকম। বাংলাদেশে সরকার যাঁদের বেতন-ভাতা দেয়, কয়েক বছর ধরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য তাঁদের বোনাস দিচ্ছে।
ঢাকা শহরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর পেছনে গোড়া থেকেই রাজনীতি ছিল এবং আছে। এ বিষয়ে আমি গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করেছি। আমার মতামতের প্রকাশ আছে ‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’ বইয়ে। এই লেখায় বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়।

ঢাকায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, তা আগে ছিল না। আশির দশকের কোনো বছরে এটা আরম্ভ হয়েছে বলে আমার ধারণা। প্রথমে প্রতি বছর শোভাযাত্রার সামনের দিকে বেগম সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, কবির চৌধুরী এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের কয়েকজন শিক্ষককে দেখা গেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধেও কিছু লোক সক্রিয় আছে। বিরোধ যাতে বড় হয়ে না উঠে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজিত করতে এবং পরাজিত রাখতে হবে। দেড় হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে আমাদের ঐতিহ্য। যারা বখতিয়ার খিলজি থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের আরম্ভ ধরে এবং দ্বিজাতিতত্ত্বকে নির্ভুল ভাবেন এবং ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে যথোচিত গুরুত্ব দেন না তাদের চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল, জনগণের জন্য ক্ষতিকর।

দ্বিজাতিতত্ত্বের সূত্র ধরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানবাদীরা পাকিস্তানকে স্থায়ী করার জন্য, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির জন্য সুপরিকল্পিতভাবে কাজ আরম্ভ করে। তারা পাকিস্তানি জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টির জন্যও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ আরম্ভ করে। শেরেবাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মণি সিংহ, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচি ও আন্দোলন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানি সংস্কৃতি সৃষ্টির সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে আছে পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং পূর্ববাংলার বাঙালি সংস্কৃতি সৃষ্টির আন্দোলন। এই ধারায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। সৃজনী, সংস্কৃতি সংসদ, ক্রান্তি, ছায়ানট প্রভৃতি সংগঠন সাংস্কৃতির আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির ধারণাকে বিকশিত ও শক্তিশালী করে তোলে। এসব আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৬০-এর দশকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ঘটনাবলিও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্তর্গত একটি আন্দোলন রূপে দেখা দেয়।

রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে আজ আমাদের দরকার উন্নত চিন্তা-চেতনার নতুন আন্দোলন। আন্দোলন বলতে আমি চিন্তা-চেতনাকে উন্নত করার আন্দোলন বুঝাচ্ছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে রক্তক্ষয়ী কর্মকাণ্ড চলছে, তা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্ধ অনুসারী হয়ে চললে আমাদের রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবন উন্নতিশীল হবে না। বাইরের জগৎ থেকে অনেক কিছু আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সব কিছুই আমাদের করতে হবে আন্তঃশক্তির ওপর নির্ভর করে।

বাংলা ভাষাকে উন্নতিশীল ভাষা রূপে বিকশিত করতে হবে। আমাদের উন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে। আরও কিছু ভাষা শেখার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। এগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনকে প্রথম স্থানে রাখতে হবে। তারপর ইংরেজিকে স্থান দিতে হবে। তারপর গুরুত্ব অনুযায়ী আরও কিছু ভাষা শেখার সুব্যবস্থা বাংলাদেশে করতে হবে। বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য পাকিস্তান-কালের ‘বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’-এর মতো একটি সংস্থা গড়ে তোলা আজ একান্ত দরকার।
বাংলা নববর্ষে সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করি।

লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com