
বিতর্ক যেন নিত্যসঙ্গী এমপি মোস্তাফিজের
পিস্তল হাতে বাঁশখালীতে মিছিল
প্রকাশ: ২৪ মে ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এমপি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর। ২০১৪ সালে এই আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন তিনি। যখন থেকে এমপি হয়েছেন তখন থেকেই একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। এই আয়োজনে সর্বশেষ সংযোজন পিস্তলসহ মিছিলে অংশগ্রহণ। মিছিলের অগ্রভাগে পিস্তল নিয়ে তিনি যেভাবে মহড়া দিয়েছেন তা নিয়ে নিন্দার ঝড় বইছে চারদিকে। এমপির অনুসারীরা বলছেন, লাইসেন্স করা পিস্তল নিয়েই মিছিল করেছেন তিনি। কিন্তু বিশিষ্টজন বলছেন, লাইসেন্স থাকার পরও একজন জনপ্রতিনিধি এভাবে প্রকাশ্যে পিস্তল নিয়ে মিছিল করতে পারেন না। এখানে আইনের ব্যত্যয় হওয়ার পাশাপাশি নীতি ও নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তাঁরা।
গত সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সোমবার বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও মিছিল করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। হাতে পিস্তল নিয়ে সেই মিছিলে অংশ নেন চট্টগ্রাম-১৬ আসনের (বাঁশখালী) সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী।
আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ অনুযায়ী এমপির এমন মহড়া আইনের লঙ্ঘন। কোনো ব্যক্তি নিজের লাইসেন্সে এন্ট্রিকৃত অস্ত্র আত্মরক্ষার নিমিত্তে নিজে বহন/ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্যের ভীতি/বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে এরূপভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। কিন্তু এ সবের কিছুকেই তোয়াক্কা করছেন না তিনি।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধি ১৭ কোটি মানুষকে ভয়ংকর এক বার্তা দিয়েছেন। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনেও এটি একটি বাজে ইঙ্গিত বহন করল। প্রকাশ্যে এভাবে পিস্তল নিয়ে মিছিল করার বৈধতা আইন কাউকে দেয়নি। কিন্তু বাঁশখালীর এমপি সেটি করেছেন এবং বহাল তবিয়তেই আছেন। আইন এখানে ভিন্ন পথে হাঁটছে।’
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য ডিএসবিকে নির্দেশ দিয়েছি। অস্ত্রটি বৈধ নাকি অবৈধ, কেন তিনি প্রকাশ্যে তা প্রদর্শন করলেন এসব বিষয় তদন্ত করে তারা আমাকে জানাবে। এরপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পুলিশের জেলা বিশেষ শাখার অতিরিক্ত সুপার আবু তৈয়ব মো. আরিফ বলেন, ‘আমরা বিষয়টির খোঁজখবর নিচ্ছি।’
যেভাবে উত্থান এমপি মোস্তাফিজের
এমপি হওয়ার আগে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স নামের একটি কোম্পানিতে জিএম পদে চাকরি করতেন মোস্তাফিজুর রহমান। এমপি হওয়ার পর গত ১০ বছরে সম্পদ বেড়েছে তাঁর ১৪ গুণ। তাঁর স্ত্রীরও সম্পদ বেড়েছে চার গুণ। এমপি হওয়ার আগে মোস্তাফিজের কোনো গাড়ি ছিল না। কিন্তু এখন তিনি ১ কোটি ২২ লাখ টাকা দামের প্রাডো জিপ ও ল্যান্ডক্রুজার স্টেশন ওয়াগন গাড়ি চালান। বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে সবসময় আলোচনায় থাকেন আওয়ামী লীগের এই এমপি। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের মারধর, অনুসারী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেও এর আগে শিরোনাম হয়েছেন বাঁশখালীর এই এমপি।
পিস্তল সব সময় সঙ্গে রাখেন তিনি
পিস্তল সব সময় সঙ্গেই রাখেন বাঁশখালীর এ এমপি। অস্ত্রের বিষয়টি জানতে মিছিলে উপস্থিত থাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফুরের সঙ্গে কথা বলে সমকাল। তিনি বলেন, ‘বাঁশখালী অন্য ১০টি জনপদের মতো না। এখানে জামায়াত-বিএনপি নাশকতার জন্য প্রস্তুত থাকে সব সময়। এ জন্য এমপি অস্ত্র বের করেছেন। তাঁর এভাবে অস্ত্র বের করাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করি।’ জীবনের ওপর হুমকি হতে পারে এমন কোনো সংবাদ তাদের কাছে ছিল কিনা–এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেরকম কিছু ছিল না।’
যে কারণে বেপরোয়া এমপি মোস্তাফিজ
অল্প সময়ে অঢেল সম্পদ হওয়া এবং দুবার এমপি হওয়ার কারণে বাঁশখালীতে বেপরোয়া আচরণ করছেন এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ২০১৪ সালের হলফনামা অনুযায়ী সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের মোট সম্পদ ছিল ১১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৪ টাকা। এমপি হওয়ার পর গত ৯ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ১৪ গুণ। ২০২১-২২ অর্থবছরে জমা দেওয়া আয়কর নথিতে এমপি মোস্তাফিজ তাঁর ১ কোটি কোটি ৬৭ লাখ ২২ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ৯ বছর আগে তাঁর আয় ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬০০ টাকা। তিনি আয় দেখিয়েছেন ৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৫ টাকা। এই হিসাবে ৯ বছরে তাঁর আয় বেড়েছে তিন গুন। সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন-ভাতা ও প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স থেকে আয় দেখিয়েছেন তিনি। আগে কিছু না থাকলেও এখন রাজউকে একটি প্লটের মালিক তিনি।
ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে মিছিলের ভিডিও
এমপি মোস্তাফিজুরের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে মিছিলের একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। ৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে এমপি মোস্তাফিজুর রহমানকে রিভলবার হাতে মিছিলের সামনে হাঁটতে দেখা যায়। একপর্যায়ে তাঁকে রিভলবারটি নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। ভিডিওতে দেখা যায় টুপি পরা এক লোক কানে কানে এসে কী যেন বলছিলেন এমপিকে। এর পর এমপি একটি প্যাকেট থেকে পিস্তল বের করে হাঁটতে থাকেন মিছিলে। একজন জনপ্রতিনিধির এমন আচরণে বিস্মিত হয়েছেন মিছিলে উপস্থিত থাকা অনেকেই।
যেসব কারণে বিতর্কিত
২০১৯ সালে এমপি মোস্তাফিজের আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে অশ্রাব্য গালাগাল করছেন বাঁশখালী থেকে নির্বাচিত সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁকে গালাগাল ছাড়াও দলের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুরও সমালোচনা করেছেন তিনি।
এছাড়া বেড়িবাঁধ নির্মাণে বরাদ্দকৃত টাকা নয়-ছয় হয়েছে বাঁশখালীতে। সেখানে যে নিম্নমানের কাজ হয়েছে তা প্রমাণ হয়েছে বুয়েটের পরীক্ষাগারেও। এমনকি নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলার ঘটনাতেও সমালোচিত হয়েছেন এমপি মোস্তাফিজ।
পিস্তল প্রসঙ্গে যা বললেন
মিছিলে প্রকাশ্যে পিস্তল বের করা প্রসঙ্গে সমকালের ফোন রিসিভ না করলেও নিজের ফেসবুক পেইজে এ প্রসঙ্গে বক্তব্য দিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি লিখেন- ‘প্রকাশ্য জনসভায় যদি বিএনপি নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে কবরে পাঠানোর মতো বক্তব্য দিতে পারেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দিতে পারেন, তবে আমি বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে অগ্নিসন্ত্রাসকারী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে মিছিলে অংশ নিলে তাতে ক্ষতি কি? বিএনপি-জামায়াতের নাশকতাকারীদের প্রতিরোধ করতে ভবিষ্যতেও জীবন বাজি রেখে মাঠে থাকতে পারলেই আমার রাজনীতির সার্থকতা।’
এমপির ব্যক্তিগত সহকারী মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলকে একাধিকবার চেষ্টার পর রাত সোয়া ৯টায় সমকালের কল রিসিভ করেন। এমপির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি পাশে নেই বলে জানান। এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সহকারী বলেন, ফেসবুক পেজে দেওয়া বক্তব্যের বাইরে এমপি মহোদয় কারও সঙ্গে অন্য কোনো কথা বলবেন না। এ প্রসঙ্গে এটাই ওনার বক্তব্য।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com