
সমকালীন প্রসঙ্গ
প্রকৃতির শিক্ষা ও আমাদের পথচলা
প্রকাশ: ২৬ মে ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ

আমরা আমাদের এ সময়টাকে বলছি আধুনিক কাল। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা অনেক এগিয়ে। পৃথিবী জয় করে মানুষ এখন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। মহাবিশ্ব থেকে অনন্ত মহাবিশ্বে আমাদের জ্ঞান। কত অভিনব আবিষ্কার প্রতিনিয়ত! আমাদের সহজ জীবনযাত্রা, কত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ! জীবনযাত্রার মান কত উন্নত! এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে জ্ঞানচর্চার বদৌলতে। অথচ আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যাত্রা শুরু মাত্র চার হাজার বছর বা তার কিছু আগে। অথচ পৃথিবীতে মানব ইতিহাস কয়েক লাখ বছর আগের। যাহোক, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কালক্রমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার হাত ধরে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্ম দেয়। আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক আর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মিশ্রণেই আমাদের আধুনিক কালের শিক্ষা। তবে শিক্ষার পরিপূর্ণতা পায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে। আমরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি জন্ম থেকে আমৃত্যু প্রতিদিন প্রতিক্ষণ হাটে-ঘাটে-মাঠে অনানুষ্ঠানিক যে শিক্ষা অর্জন করি, সে শিক্ষাই জীবন চলার পথে আমাদের পাথেয়। কারণ শিক্ষার মূল ভিত্তিই হলো অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা।
মানবেতিহাসের সূচনালগ্নেই শিক্ষার বিষয়টি নিহিত ছিল তাদের জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলার জন্য। সর্বোপরি বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অতি আবশ্যক ছিল শিক্ষা। পৃথিবীর কোথাও উন্নত, কোথাও অবনত; কোথাও পাহাড়-পর্বত, কোথাও সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা; কোথাও মরুভূমি, কোথাও চিরসবুজ তরুছায়া; কোথাও হিমশীতল বরফ। কত ফুল-ফল, কত পশু-পাখি; কখনও গরম, কখনও বা শীত; কখনও বা বৃষ্টি, কখনও রাত, কখনও দিন। কত বৈচিত্র্যে ভরা এ পৃথিবী। কোনটি ভালো কোনটি মন্দ, কোনটি খাদ্য, কোনটি খাওয়ার অযোগ্য, কোনটি প্রয়োজন জীবনের জন্য– জানা বা বোঝা বেশ কঠিন। তখন মানুষের শত্রু ছিল মানুষ, অন্য কোনো গোত্র, হিংস্র জীবজন্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রকৃত শিক্ষার অভাব। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত তাদের লড়াই করতে হতো সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে, অনেক ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে, ঘাটে ঘাটে ঠেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণ নতুন নতুন শিক্ষায় নিজেদের সমৃদ্ধ করে মানব সভ্যতার ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছে তারা। করেছে আধুনিক সভ্যতার সুবিশাল অট্টালিকার ভিত রচনা; গেঁথেছে নিপুণ হাতে সভ্যতার একেকটি শৈল্পিক ইট; করেছে নান্দনিক কারুকাজ। এ শিক্ষা ছিল মূলত অনানুষ্ঠানিক। তাদের শিক্ষাগুরু ছিল একান্তই প্রকৃতি। ভাষা ছিল হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার মতো নির্বাক। আর মানুষ প্রকৃতির বিশিষ্ট উপাদান।
প্রকৃতির কত রং, কত রূপ! একেক সময় একেক পোশাকে নিজেকে সাজায় মনের খেয়ালে। গোধূলিতে টুকটুকে লাল শাড়ি আর কপালে লাল টিপ পরে রোমান্সে মেতে ওঠে সবার অলক্ষ্যে। মৃদু হাওয়ায় চন্দ্রালোকে খেলে লুকোচুরি খেলা। প্রত্যুষে হাজারো পাখির কূজনে প্রশান্তির উজ্জ্বল হাসি রবির কিরণে। নরম ঘাসের ডগায় চোখ ধাঁধায় হীরার অলংকার। কখনও খরাহত তপ্ত হৃদয়ে বর্ষার জলে মনটা ভিজিয়ে নেয়। কদম ফুলের খোঁপায় ধীর লয়ে এগিয়ে যায় শ্বেতশুভ্র কাশবনে। শীতের উশকোখুশকো ভাব ছাড়িয়ে বাসন্তী রং শাড়ি পরে হাজারো ফুলের মাতাল সুবাসে সাদর সম্ভাষণ জানায় ঋতুরাজ বসন্তকে। আবার গ্রীষ্মের তাপদাহে ফুঁসে ওঠে কালবৈশাখী তাণ্ডবে। লন্ডভন্ড করে দেয় হৃদয় নিংড়ানো সঞ্চিত ভালোবাসা। শত কষ্ট চেপে ধরে আবার আশায় বুক বাঁধে। ভরা যৌবনে বহতা নদীগুলো এ-কূল ভাঙে, ও-কূল গড়ে। এক সময় শুকিয়ে নিস্তেজ হয়ে অপেক্ষায় থাকে পুনর্যৌবনের। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির শিক্ষা।
ঈগল পাখির আয়ু প্রায় ৭০ বছর। যখন তারা ৪০ বছরে পদার্পণ করে তখন তাদের ঠোঁট আর পায়ের নখর অনেক বড় হয়ে শিকারের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে তারা শিকার ধরতে অক্ষম হয়ে যায়। পাখা ভারী হয়ে উড়তে পারে না ঠিকমতো। তখন তাদের জন্য দুটি পথ খোলা থাকে। হয় মৃত্যুকে সাদরে আলিঙ্গন করা নতুবা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তারা দ্বিতীয়টি বেছে নেয়। জীবনের জন্য দূর পাহাড়ে নির্জনে চলে যায় তারা। সেখানে শক্ত পাথরে ঠোকরাতে থাকে। রক্তাক্ত হয়ে এক সময় অকার্যকর ঠোঁট ভেঙে যায়। একইভাবে শিকারি-অস্ত্র পায়ের নখরগুলো ভেঙে ফেলে। পাখা দুটো হালকা করে নেয়। রক্তাক্ত দেহে ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে। তবু প্রতীক্ষার প্রহর গোনে– কখন নতুন ঠোঁট আর নতুন নখর গজায়। এক সময় সে পুনর্যৌবন পায়। আবার শুরু হয় নতুন জীবন। নতুনভাবে পথচলা। এটি প্রকৃতির শিক্ষা। আমাদের জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা।
আমাদের অনেকেই আছেন, যাঁরা জীবন চলার পথে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে পৃথিবীর জঞ্জাল মনে করেন। চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে মুষড়ে পড়েন। নিজেকে সংকুচিত করে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেন। অনেক কিছু নেওয়া এবং দেওয়ার জন্য ভান্ডারের অবশিষ্ট খোঁজার ফুরসত নেই তাঁর। বোধশক্তি দৃষ্টিসীমার অনেক দূরে কুহেলিকায় ঢাকা পড়ে। অনিন্দ্যসুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্যসুধা থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করেন। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, পৃথিবীতে শুধুই সুখ, আনন্দ, সফলতা অথবা শুধুই দুঃখ, বেদনা, ব্যর্থতা মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ নয়। বরং সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সফলতা-ব্যর্থতার সমন্বয়েই মানুষের জীবন। জীবন চলার পথ তাই সব সময় মসৃণ আর ফুলশয্যাসম নয়। আমাদের সব দুঃখ-বেদনা আর ব্যর্থতার কালে দ্বারস্থ হতে হবে প্রকৃতির। শিক্ষা নিতে হবে আত্মবিশ্বাসে। চরম ধৈর্যে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তবেই ব্যর্থতা হয়ে উঠবে সফলতার অনুপ্রেরণা। দুঃখ-বেদনায় সুখের প্রত্যাশা।
শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ: অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com