
অর্থনীতি
ব্যয় সংকোচনের বাজেটই জরুরি
প্রকাশ: ২৬ মে ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবু আহমেদ

আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশের সময় একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। যদিও এর মূল বিষয়গুলো ইতোমধ্যে নির্ধারণ হয়ে গেছে, তবুও বিভিন্ন মহল থকে দাবি-দাওয়া তোলা হচ্ছে। আশা থাকে, যৌক্তিক দাবি হলে শেষ মুহূর্তেও সরকার শুনতে
পারে, সংশোধন করতে পারে। আমিও সেই আশায় দুটি কথা বলতে চাই।
এবারের বাজেট যেহেতু নির্বাচনী বছরের বাজেট, তাই এটি নিয়ে সব মহলের আগ্রহ আছে। গত চার-পাঁচটি বাজেটের তুলনায় আগামী বাজেট বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। চ্যালেঞ্জিং এই অর্থে– অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি ছিল, সেটি এখন নিম্নমুখী। প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হলে রাজস্ব আয় এবং কর সংগ্রহ কমে যায়। গত বছরের চেয়ে বেশি ট্যাক্স আদায়ের টার্গেট দেওয়া হয়েছে। এটা হলে জনসাধারণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
ভুলে যাওয়া চলবে না, করপোরেট ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়ালে তার প্রভাব ব্যবসায় পড়বে। আমাদের আশপাশের যেসব দেশ, সেখানে এই হারে ট্যাক্স নেওয়া হয় না। আমাদের দেশে ট্যাক্স কত আদায় হলো, কত করা গেল না, সেটা ভিন্ন আলাপ। কিন্তু এখানে ট্যাক্স রেটের পরিমাণ বেশি। এটা এ জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় রয়েছে। সে জন্য যেটা করা উচিত, আমি মনে করি, সরকারের নিজের ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গত বছরের তুলনায় কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে ঘাটতি বাজেট বড় হতে থাকবে। এখান থেকেই সমস্যা তৈরি হবে। এই ঘাটতি বাজেট পূরণ করা হয় বৈদেশিক ঋণ নিয়ে। ইতোমধ্যে আমরা একটি বড় ধরনের ঋণের মধ্যে পড়েছি, যেটি তিন বছর আগে ছিল না। সত্যি কথা বলতে, গত দুই বছরের মধ্যে বিশাল আকারের একটি ঋণের বোঝা বয়ে চলেছি।
সমস্যা হচ্ছে, এসব ঋণের সুদ ও কিস্তি ডলারের মাধ্যমে শোধ করতে হবে। যেহেতু আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই, তাই এই ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এখন যে রিজার্ভ আছে, তার চেয়ে বেড়ে যাবে– এমন আশা করতে পারি না। যদি এর চেয়ে আরও কমে যায় তাহলেই সমস্যায় পড়তে হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, চীন, রাশিয়া, জাপান– যাদের থেকেই ঋণ আনা হয়েছে, তাদের ঋণ পরিশোধের সময় অর্থাৎ কিস্তি দেওয়ার সময় চলে আসবে। আবার আদানির বিদ্যুতের জন্য যে অর্থ, সেটিও শোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন জ্বালানির মূল্য পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের অভাবে ভুগতে শুরু করছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে নিজেদের খরচ কমিয়ে আনার। এখন নিজেদের ব্যয় সংকোচনের কোনো বিকল্প নেই। বলা হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হবে। আমি মনে করি, এটাও স্থগিত রাখা উচিত। যেহেতু নির্বাচনের বছর, তাই সরকার হয়তো এটা থেকে সহসা সরে দাঁড়াবে না। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ালে তার প্রভাব দেশের সাধারণ নাগরিকের ওপরে পড়বে। সমাজে যারা সবচেয়ে গরিব এমন ৩০ শতাংশ এবং নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত আরও ২০ শতাংশ রয়েছে। এই ৫০ শতাংশ লোকের কী হবে? যাঁরা অবসর জীবন যাপন করছেন, যাঁদের আয় নেই, তাঁদের কী হবে? যাঁরা সরকারি চাকরিতে আছেন, তাঁদের তো অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আছে।
এখন যেটি সবচেয়ে জরুরি, সরকারের নিজের ব্যয় সংকোচন করতে হবে। এই ব্যয় সংকোচন নীতি যদি বাজেটে প্রতিফলিত হয়, তাহলে সবার জন্যই মঙ্গল। এটা ঠিক, সরকার অতীতেও ঋণ করে ঘি খেয়েছে। এখনও যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে ভবিষ্যতে আরও গভীর সমস্যায় পড়তে হবে। যেমনটা আমাদের কোনো কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে হয়েছে। এই ভ্রান্তি শোধরানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ এনে দিতে পারে আসন্ন বাজেট।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, গত দুই মাসে আমাদের রপ্তানি আয় কমেছে। আমাদের রপ্তানি আয় নির্ভর করে তৈরি পোশাক খাতের ওপর। এখানেও তো আয় নিম্নমুখী। আমাদের অর্থনীতি মূলত দুটি বিষয়ের ওপর প্রবাহিত– বৈদেশিক আয় এবং তৈরি পোশাক। আবার আরেকটি বিষয় আছে; বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখে। কিন্তু এখন আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, তাও বলা যাবে না। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া আমাদের চেয়েও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে। এসব কারণে ঘাটতি বাজেট বেশি রাখা যাবে না।
এখন যদি সরকার ট্যাক্স আদায়ের জন্য বিভিন্ন এজেন্সিকে নিয়োগ করে তাহলে তারা লক্ষ্য পূরণের জন্য ডানে-বামে সবাইকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে শুরু করবে। দেশে যাঁরা এখন ট্যাক্স দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর ট্যাক্সের বোঝা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। এখানে যাঁরা অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, যাঁরা ঋণখেলাপি, তাঁরা ভালো আছেন। যাঁরা আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং করতে পেরেছেন, তাঁরা ভালো অবস্থানে।
আবার এখানে প্রকল্পের মেয়াদ অযথা বাড়ানো হয়। যেমন তিন বছরের কাজের জন্য পাঁচ বছর কিংবা চার বছরের কাজের জন্য ৯ বছরের মেয়াদ লাগিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের অন্যতম কারণ। কেবল অতিরিক্ত ব্যয় হয়, তা নয়। এর ফলে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগও বাড়ে। এমনও আছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যে প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব, সেটাও ঝুলিয়ে রাখা হয় ব্যয় বাড়ানোর জন্য।
মনে রাখতে হবে, সরকারের আয় বলতে তো আলাদা কিছু নেই। সরকারের আয় হচ্ছে জনগণের অর্থ ব্যয়। এখন এই যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে জনগণের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, এটা দেখার জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে শুরু করে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে। এ জন্য সরকারের আরও ধীরে চলো নীতিতে চলা ভালো। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পদ্ধতি থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। বিশেষ করে যখন প্রকল্প ব্যয় বছর বছর বেড়েই চলে, তখন ব্যয়ের লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়বে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে, তার ওপর দেশের অর্থনীতি নির্ভর করবে। একটি ভালো নির্বাচন যদি হয়, তাহলে অর্থনীতিও চাঙ্গা হতে পারবে। যেটা সরাসরি বলতে চাই, একটি ভালো নির্বাচন অর্থনীতিতে গতি এনে দিতে পারবে। বিশেষ করে সব পর্যায়ে জবাবদিহি এনে দিতে হবে। এখন এই জবাবদিহি আনতে হলে সবাই যেটাকে ভালো নির্বাচন বলবে, তেমন একটি নির্বাচনের বিকল্প নেই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে অর্থনীতির যে অধোগামিতা, তা থেকে উদ্ধার পাব না।
আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের দিকে তাকালে পরিস্থিতি ও করণীয় সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে। এ দুটি দেশও ঋণ করে ঘি খেতে গিয়েছিল। সেখানেও জবাবদিহির অভাব ছিল। তাই দেশে জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে এবং সরকার ব্যয় সংকোচন করলে বাজেট নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। এতে একদিকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে, অন্যদিকে অপচয়ের সুযোগও কমে যাবে।
ড. আবু আহমেদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; প্রাক্তন অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com