
প্রচ্ছদ
পেছনে তাকিয়ে দেখি– মুগ্ধতা
প্রকাশ: ২৬ মে ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাসা ছিল রূপশ্রী সিনেমা হলের পাশে কালাইশ্রী পাড়ায়। হলে কোনো নতুন ছবি এলেই দেখতাম। সেই সূত্রে সুচিত্রা সেনের প্রতি মুগ্ধতার শুরু। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। তবে এ মুগ্ধতা এখানেই শেষ হয়নি। সুচিত্রা সেন থেকে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সে সময়কার গানের প্রতিও। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে পূর্ববঙ্গের সিনেমা হলগুলোতে যে সিনেমা প্রদর্শিত হতো, তার একটা বড় অংশই ছিল ভারতীয় বাংলা ছায়াছবি। তখন রেডিওতে ওই গানগুলো বারবার শোনানো হতো। আমার কাছে রেডিও ছিল না। পাড়ার দোকানগুলোতে মাইকে গানগুলো বাজত। তা বাসা থেকেই শোনা যেত। ওই গানগুলো যেসব সিনেমার, তার সবগুলো দেখা হয়নি। তবে মাইকে শুনে শুনে গানগুলো গুনগুন করতাম। সতীনাথ, হেমন্ত, মান্না দে, সন্ধ্যা, লতা, শ্যামল দত্তের গাওয়া গানগুলো আজও শুনলে সেসময়ে চলে যাওয়া যায়। ফেসবুকে এখন আমি মাঝে মাঝে যে গানগুলো গুনগুন করে আপলোড করি, তা ওই সময়ে মাইকে শোনা গানগুলোই। তবে তখনকার অনেক জনপ্রিয় গান আমার তেমন ভালো লাগত না; বরং এমন অনেক গান, যেগুলো কম জনপ্রিয় হয়েছিল, তা আমার বেশি পছন্দের। তখন জনপ্রিয় গান ছিল শ্যামল মিত্রের ‘ঐ আঁকা-বাঁকা পথ যে যায় সুদূরে’, ‘নাম রেখেছি বনলতা’। শ্যামল মিত্রের শহরের ইতিকথা ছবির ‘কত ফাগুনের মাধুরী’ গানটি তেমন জনপ্রিয় হয়নি; কিন্তু আমার ভীষণ প্রিয়। শ্যামল মিত্রের এমনই আরেকটি গান ভ্রান্তি বিলাস ছবির ‘সেই বাসর নেই, বাঁশরী নেই’। সে সময় খুব জনপ্রিয় ছিল– হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘ কালো, আঁধার কালো’, মান্না দের ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘আকাশ এত মেঘলা’। এখন সে সময়ের অনেক গান আবার নতুন করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর মধ্যে ‘লুকোচুরি’ সিনেমার কিশোর কুমারের গাওয়া ‘এই যে হেথায়’ উল্লেখযোগ্য।
তখন অনেক পরিবারও ছিল, যারা গান করত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এমনি একটি পরিবারের খোঁজ পাই আমরা। তাঁরা তখন সারা পাকিস্তানে শাস্ত্রীয় সংগীতে প্রথম হয়েছিল। আমি, আমার ভাই এবং এক দুলাভাই সাইকেল নিয়ে রওনা দেই ওই পরিবারের খোঁজে। সেখানে গিয়ে তাঁদের দুই ছেলের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে যায়। তাঁরা আমাদের দুটি গান শুনিয়েছিলেন– ‘তুমি আর আমি শুধু’ এবং ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে যেদিন আমাদের ‘ফিস্ট’ হতো– দিনভর মাইকে গান বাজানো হতো। সেখানেও ওই গানগুলোই বাজত। আবার রেডিওতে অনুরোধের আসর ছিল। আমি সেখানে অনুরোধ করেও গান শুনেছি। একবার একটা গান অনুরোধ করেছিলাম মজা করতে– ‘ও আকাশ, প্রদীপ জ্বেলো না/ ও বাতাস, আঁখি মেলো না ...’
একবার রূপশ্রী সিনেমা হলে এলো সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘পথে হল দেরী’। তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। এটা ১৯৬২ সালের কথা। আমি প্রথম শ্রেণির টিকিট কেটে বসেছিলাম। তখনকার দিনে ‘বক্স’ বলে একটা জায়গা ছিল। প্রথম শ্রেণির আসনের পাশেই দুই দিকে দুইটা বক্স থাকত। এখানে সরকারি কর্মকর্তা বা এলাকার গণ্যমান্য লোকজন পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখতেন। একটা বক্সে আমার খুব পরিচিত এক ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবার। তাঁরা আমাদের পাশের বাসাতেই থাকতেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘আরে, তুমি এখানে বসে আছো! আসো, আসো, আমাদের পাশে বসো।’ উনার চার-পাঁচজন মেয়ে, দুই-তিনজন ছেলে। তাঁরা সবাই পরে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উনার তৃতীয় মেয়ে আমার ক্লাসে পড়ত। আমাদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাকে বক্সে ডেকে নেওয়ায় আমি তো খুব খুশি। একে তো ভালো লাগার ছবি দেখছি। তার ওপর বান্ধবী আমার পাশে। ওর সঙ্গে আমার ঠিক রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ছোট বয়সে যে ভালো লাগা কাজ করে সেই আকর্ষণটুকু ছিল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।
এ ঘটনাটিও নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়কালেরই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুন্সেফপাড়ায় তখন যে মুন্সেফ সাহেব ছিলেন, তাঁর একটাই মেয়ে ছিল। সে কলেজে পড়ত। ওকে আমি স্কুলে যাওয়ার পথে বরাবরই লক্ষ্য করতাম। রিকশায় করে কলেজে আসা-যাওয়া করত। জীবনে আমি এত সুন্দরী মেয়ে আর দেখিনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে।
এরই মধ্যে এসএসসি প্রথম পর্বের ফল প্রকাশিত হয়েছে। তখন নবম ও দশম শ্রেণিতে দুই পর্বে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হতো। প্রথম পর্বের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল– আমি গোটা পূর্ববঙ্গে প্রথম হয়েছি। আমি জানতাম না যে, মুন্সেফ সাহেবের ওই কলেজপড়ুয়া মেয়েও আমাকে বেশ লক্ষ্য করত। আমার মা-বোন ওদের বাসায় কখনও গেলে জিজ্ঞেস করত। বাবা যখন বান্দরবানে বদলি হন, তখন আমি, মা ও বোন তাঁদের বাড়িতে ছিলাম। আমি একাই ছেলে ওই বাড়িতে। খুব ইচ্ছে করত, গিয়ে ওর সঙ্গে একটু আলাপ করি; কিন্তু সংকোচবোধ কাটত না। ওর বাবা যখন বরিশাল বদলি হয়ে গেল, সেসময় তাঁরা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। তখনও কথা হয়নি ওর সঙ্গে। এখন মনে হয়, আমাকে তাঁরা এত ভালো জানেন, আমি কেন তাঁদের সঙ্গে গিয়ে কথা বললাম না! আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে কখনও কথা না বলার আক্ষেপটুকু থেকেই যাবে।
ছোট বয়সে একটু বড় মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ ছিল। আমরা ৮-১০ বছরের বাচ্চারা মিলে যখন খেলতাম গোল্লাছুট, তখন আমার সমবয়সী মেয়েদের দিকে সেভাবে তাকাতাম না। আমার মোহ হতো নবম-দশম শ্রেণির মেয়েদের প্রতি। আরেকটু বড় হওয়ার পর, সতেরো-আঠারো বছরের মেয়েদের প্রতি মোহ তৈরি হলো। ছেলেদের এমন আচরণ খুবই স্বাভাবিক। পরে আমি এ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি– কীভাবে মস্তিষ্কে যৌনতার বিষয়টি কাজ করে। ছেলেদের আর মেয়েদের মস্তিষ্কের গঠন ভিন্ন। তা একভাবে কাজ করে না। এটা না বুঝতে পারার কারণে অনেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ভুল বোঝাবুঝি হয়। যা-ই হোক, বেশি বয়সী মেয়েদের প্রতি মোহ কাজ করার কারণ হলো– প্রাকৃতিক নিয়মেই নারী শরীর আকর্ষণীয় হলে তা যে বয়সের পুরুষই হোক না কেন, তাকে আকর্ষিত করবে। বাচ্চা মেয়েদের মধ্যে তো সেই আকর্ষণ নেই। ওই বয়সে তো এমন চিন্তা নেই যে, তাঁকে বিয়ে করতে হবে বা সংসার করতে হবে, এমনকি প্রেম করার চিন্তাটাও থাকে না। থাকে শুধু এক ধরনের আবেশ। এক অদ্ভুত ভালো লাগা। পরিণত বয়সে আমি যখন এ নিয়ে ভেবেছি, পড়েছি; তখন বুঝতে পেরেছি– নারী অঙ্গের যে বৈশিষ্ট্য, তা ছেলেদের আকর্ষণ করে, এক ধরনের মোহ তৈরি করে।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে এক অন্যরকম মুগ্ধতার দেখা পাই। আমার ইংরেজি পড়াতেন মোহাম্মদ নোমান। পরে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হয়েছিলেন। শুধু পড়াতেন বললে ভুল হবে। ব্রাউনিং, টেনিসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় তিনি রীতিমতো মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন। আমি যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম; পরে জেনেছি, সেটা তিনিও বুঝতেন। আমার আরেকজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি আমার খুব খোঁজখবর রাখতেন। তাঁর নাম খন্দকার রেজাউর রহমান। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হয়েছিলেন। আমিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একদিন কথা প্রসঙ্গে খন্দকার রেজাউর রহমান স্যারকে নোমান স্যারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন, স্যারের আর পড়াতে তেমন ভালো লাগে না। নোমান স্যার বলেছেন, ‘এখন আর ওয়াহিদের মতো এত মুগ্ধ হয়ে কেউ তাকিয়ে থাকে না!’ তখন বুঝলাম, আসলেই আমি মুগ্ধ ছিলাম।
নোমান স্যারের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি ইংরেজির অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকজন ভাই-বোন ছিল। তিনি ছিলেন বড় ছেলে। তাঁর ভাইয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে বিদেশ থেকে পিএইচডি করা হয়নি স্যারের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। প্রথম বর্ষে পড়ি। এসএম হলের এজিএস পদে জয়ী হয়েছি। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত এর মেয়াদ ছিল। তখন কোনো কারণে আমাদের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন না। সেই দায়িত্বও বর্তায় আমার ওপর। প্রতি বছর আমাদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। মূল অনুষ্ঠানের আগে কিছুদিন ধরে বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, নাটক– এসবের ওপর প্রতিযোগিতা হয়। সেই প্রতিযোগিতার জন্য যে পুরস্কার দেওয়া হয়, তাও আমি ব্যবস্থা করেছি। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া বই কিনেছিলাম নিউমার্কেট থেকে। তখন নিউমার্কেটে বইয়ের খুব সুন্দর দোকান ছিল। এখন আর এসব বইয়ের দোকান অবশিষ্ট নেই সেখানে। যা-ই হোক, ওই পুরো অনুষ্ঠান নিয়ে আমার এক ধরনের মুগ্ধতা ছিল। টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা। সব ঘটনা যে ভালো লাগার ছিল, এমন নয়। অনুষ্ঠানের আগের রাতে দেয়ালে আমরা পোস্টার লাগাতাম। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন কথা সেখানে লেখা থাকত। সবই আমাদের হাতে লেখা। বিকেলেই আমরা পোস্টার লাগিয়ে ফেলেছিলাম। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। তবে সে সময়ে প্রায় অর্ধেক পদ ছিল সরকারি পেটুয়া বাহিনী এনএসএফের দখলে। পরে এনএসএফের মধ্যে বিভক্তি সুস্পষ্ট হয়। হলে এনএসএফের তৎকালীন নেতা ছিলেন জমির আলী। তাঁদের একটা মাস্তানি ভাব ছিল। জমির আলী এসে সবগুলো লেখা দেখে ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’ বলে একটা পোস্টার টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল। সেখানে তেমন আপত্তিকর কিছুই লেখা ছিল না। তবে তিনি ভেবেছিলেন, হিন্দুভাবাপন্ন কিছু একটা লেখা হয়েছিল। ওই পোস্টারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রূপ-নারানের কূলে’ কবিতার কয়েকটি লাইন লেখা ছিল–
রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ …
আমি কষ্ট পেলেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ছিঁড়লেন কেন?’ জবাবে জমির আলী বললেন, ‘এসব হিন্দুদের জিনিস রাখা যাবে না।’ আমার ধারণা ‘রক্তের অক্ষরে’ কথাটি দেখে তিনি হয়তো ভীত হয়েছিলেন। জমির আলী পরে মুসলিম লীগের একাংশের নেতা হয়েছিলেন।
ওই অনুষ্ঠানে অনেক ভালো অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। আমার এক বান্ধবী পদার্থবিজ্ঞানে পড়ত। সে ও তাঁর বান্ধবীদের আমন্ত্রণ জানালাম। তাঁদের বসালাম। নাশিদ কামাল তখন নবম শ্রেণিতে পড়ত। সে পড়ে পিএইচডি করেছে। নাশিদ আমার ছোট বোনের মতো। তবে তখন ওকে এত ভালো চিনতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল। ফেরদৌসী রহমানের ভাগনি হিসেবে তাঁকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে হবে– সে খুব ভালো ভাওয়াইয়া গান গায়। তবে অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বড় মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন সুজাতা। তিনি তখন সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা। অনুষ্ঠান আয়োজনে বড় ভূমিকা ছিল বলে অন্যরকম অনুভূতিও ছিল।
আমার জীবনে পরীক্ষায় ভালো ফলের একটা মুগ্ধতা বরাবরই ছিল। ক্লাস টেস্ট, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক, বৃত্তি, বোর্ড পরীক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আমি সেকেন্ড হইনি। বাবার সরকারি চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া হয়েছে, পড়াও হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে পড়ার সময়ে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলাম। সেটার পরিসর ছিল লক্ষ্মীপুর জেলা পর্যন্ত। এরপর চট্টগ্রাম রেঞ্জে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলাম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বৃত্তি পরীক্ষায় সিলেট রেঞ্জের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। তখন থেকেই লোকজন আমাকে চিনত। তবে নবম শ্রেণিতে এসএসসি প্রথম পর্বে প্রথম হওয়ার পরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আমি বেশ সেলিব্রেটি মর্যাদা পেয়ে যাই। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কলেজ না থাকলে আমি ফল এতটা ভালো করতাম না হয়তো। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই আমি ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ স্তরের বই থেকে পড়েছি। ফলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে উত্তর লিখতে পেরেছি, যেখানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পাঠ্যবইকে কেন্দ্র করে পড়াশোনা করে থাকে। আবার এমনও নয় যে, বড় ক্লাসের যা পড়ছি, সব মুখস্থ লিখেছি। বরং পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে কিছু সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা বড় ক্লাসের বই থেকে যুক্ত করেছি। এতে পরীক্ষক মান যাচাইয়ের সময় এটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আমি চার বছর পড়েছি। আমরাই একমাত্র ব্যাচ ছিলাম, যারা এসএসসি দুই বছরে পাস করেছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ছোট একটি শহর থেকে প্রথম হওয়াটা এক বিশেষ ভালো লাগার বিষয়। তখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ হয়ে গেছে। প্রথম স্থান আসত সেন্ট গ্রেগরি থেকে, অথবা ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। বাকিরা বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ থেকে আসত। কখনও হয়তো রাজশাহী থেকে কেউ স্থান পেয়েছেন। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ১৯৬২ সালের আগ পর্যন্ত সেরা ৩০ শিক্ষার্থীর তালিকা বিশ্লেষণ করলে অনেকটা এমনই দেখা যাবে। এর বাইরে কখনও বা মতলব উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করত কেউ কেউ। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি মহকুমা মাত্র। এ রকম এলাকা থেকে প্রথম হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরে শুনেছিলাম, আমার পরীক্ষার খাতা দেখেছিলেন ময়মনসিংহের এক শিক্ষক। তিনি পরে নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতেও চেয়েছিলেন। ওই স্যারের শিক্ষার্থীরাই পরে তা জানিয়েছেন। তবে স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
নবম শ্রেণিতে এসএসসি প্রথম পর্বের ফলে দেখা গেছে, গোটা পূর্ববঙ্গে আমি প্রায় ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় যে হয়েছিল, সে পেয়েছিল প্রায় ৭৬ শতাংশ নম্বর। পার্থক্যটা অনেক বেশি ছিল। এগুলো জানাজানি হয়ে যায়। তখনকার দিনে বোর্ড কর্মকর্তারা ভীষণ শিক্ষাপ্রেমী ছিলেন। যিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, তিনি আমার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ডেকে এনে নম্বরগুলো দেখিয়েছেন। তখনও নম্বরগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়েছে। কারণ, বোর্ড নিজ থেকে এটা জানিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সবাই এটা জানত। আমি যেখানেই যেতাম, সেখানে এ বিষয়টা আসত। লোকজন আমার দিকে তাকাত। আমি তা অনুভব করতে পারতাম। যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার জন্ম হয়নি, তবু আমার জীবনে এ জায়গাটির বিশেষ অবস্থান রয়েছে।
এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়ও মানবিক বিভাগ থেকে প্রথম হলাম। যদিও সব বিভাগ মিলিয়ে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পাইনি। রেডিও থেকে দেওয়া ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান হওয়ার পর আইএ পরীক্ষায় এটা ছিল সর্বোচ্চ নম্বর– ৮৭.৭ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর একই অবস্থা চলছিল। তবে এমন নয় যে, আমি সারাদিন শুধু পড়তাম। বরং আমি সব কাজ ঠিক রেখে পড়তাম। ইসলামাবাদ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে যখন স্নাতকোত্তর করেছি, তখনও প্রথম স্থানই পেয়েছি। প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। তবে এটা কোনো বড় বিষয় না। প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হওয়া দিয়ে প্রকৃত মেধা যাচাই হওয়া সম্ভব নয়। বরং এটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। সেই সঙ্গে একরকম চাপও সৃষ্টি হয়।
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত শিল্পকর্মগুলো ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের আঁকা
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com