
বর্ষার আগেই বাড়ছে ডেঙ্গু
প্রকাশ: ২৭ মে ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তবিবুর রহমান ও লতিফুল ইসলাম

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৯ সালে। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বিস্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ রোগের সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়। তবে চলতি বছর দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। বর্ষা শুরুর আগেই লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু। এ মাসের ২৬ দিনে ৬৩৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে, যা গত পাঁচ বছরের মে মাসে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায়। দেশের মোট শনাক্তের ৬২ শতাংশই এ সিটির এলাকাগুলোতে। এ ছাড়া ডেঙ্গু ছড়িয়েছে দেশের অন্তত ৫০টি জেলায়।
কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণহীন। তাঁরা মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশা নিধন কর্মসূচি সারা বছর অব্যাহতভাবে রাখতে হবে। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগাক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অন্তত দু’জন। গত বছর মে মাসে ডেঙ্গু শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৬৩ জন, কারও মৃত্যু হয়নি। ২০২১ সালে করোনা মহামারি চলাকালে মে মাসে ৪১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়, কেউ মারা যাননি। আগের ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৯৩ এবং ২০১৯ সালে ৪৩ জন। ওই বছরগুলোতেও মে মাসে কারও মৃত্যু হয়নি।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৬ মে পর্যন্ত ১ হাজার ৬২৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে শনাক্ত ও মৃত্যুর এমন চিত্র আর দেখা যায়নি। গত বছর প্রথম পাঁচ মাসে শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৩৫২ জন। কারও মৃত্যু হয়নি। সে তুলনায় এ বছর শনাক্ত বেড়েছে ৩৬০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বেশিরভাগ রোগী জটিল পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ফলে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে কারও কারও মৃত্যু হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়া ৭২২ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি রোগী রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার। গত বছর সর্বোচ্চ রোগী পাওয়া গিয়েছিল মুগদায়। যাত্রাবাড়ীর পরই কেরানীগঞ্জ ও কাজলা, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মুগদা ও জুরাইন রয়েছে। এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের ৬১ দশমিক ৮ শতাংশই ঢাকা দক্ষিণ সিটির। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) আক্রান্তের হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। রাজধানীর বাইরে রয়েছে শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। আক্রান্তদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ ও ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, দেশে দ্রুত নগরায়ণ, ঢাকার প্রতিটি বাড়িতে পার্কিংয়ে গাড়ি পরিষ্কারের জন্য দীর্ঘদিন পানি জমিয়ে রাখা, কিছু এলাকায় পানির সংকটের কারণে বাসাবাড়িতে পাত্রে পানি জমিয়ে রাখায়ও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বিস্তার বাড়ছে। এগুলোতে সারাবছর এডিস মশা জন্মায়। এ বছর এডিস মশার ঘনত্ব বেশি দেখা যাচ্ছে। মের শুরুতেই বৃষ্টি হওয়ায় জ্যামিতিক হারে রোগী বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণে মশা নিধনে জনসম্পৃক্ততা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে উড়ন্ত এডিস মশা নিধন কর্মসূচি জরুরি।
এবার মশা নিধন কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেজর জোবায়দুর রহমান সমকালকে বলেন, এখন ডেঙ্গু বাড়ার সময়। এপ্রিল-মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এডিসের প্রজনন বাড়ে। মূলত এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত তুলনামূলক অনেক কম। তিনি বলেন, আগের ফগিং পদ্ধতি কমিয়ে এনে লার্ভিসাইড কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। কারণ, ফগিংয়ের ফলে মশা উড়ে আরও ওপরে চলে যায়। শতভাগ মশা নিধনে লার্ভিসাইড কার্যকর পদ্ধতি। ভোরের সূর্যের তাপ যত বাড়ে, লার্ভা তত পানির নিচে চলে যায়। তাই সকালেই লার্ভা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মশক কর্মীরা সকালে যাচ্ছেন কিনা, তা ডিজিটাল হাজিরার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, নির্মণাধীন প্রায় শতভাগ ভবনে মশার লার্ভা পাওয়া যায়। তাই সেসব ভবন ও স্থাপনায় যেন এডিসের প্রজননস্থল সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সবার যথাযথ তদারকি প্রয়োজন। নিজেরা এডিসের প্রজননস্থল নির্মূল না করতে পারলে, সিটি করপোরেশনকে জানাতে হবে। ডেঙ্গু থেকে ঢাকাবাসীকে সুরক্ষা দিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, চলতি বছর এ সময় পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও বর্ষা মৌসুম শুরুই হয়নি। এ জন্য আগে থেকেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com