ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

লিম্ফোমা, স্তন ও ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী বেশি

লিম্ফোমা, স্তন ও ফুসফুস  ক্যান্সারের রোগী বেশি

চট্টগ্রাম মা ও শিশু ক্যান্সার হাসপাতাল রোগীদের আস্থার ঠিকানা হয়ে উঠেছে কম খরচে সর্বাধুনিক চিকিৎসা মিলছে এখানে- সমকাল

 শৈবাল আচার্য্য

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৫

চিকিৎসাসেবায় চট্টগ্রামবাসীর আস্থা ও ভরসার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (ক্যান্সার হাসপাতাল)। গরিব-অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার সহজ মাধ্যমও এখন এটি। ক্যান্সার হাসপাতালটি খুব কম সময়ে ভরসার ঠিকানা হিসেবে রোগীদের মন জয় করে নিয়েছে। কারণ ঢাকাসহ চট্টগ্রামের অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় একেবারে কম খরচে ক্যান্সার রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারেন এখান থেকে। এসব সম্ভব হয়েছে হাসপাতালের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির নানা উদ্যোগ ও সঠিক পরিকল্পনার কারণে। মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেই চট্টগ্রামবাসী তথা দেশের জন্য এত বড় একটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউট বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন কমিটির সদস্যরা। দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায়ও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এটি। এ ইনস্টিটিউট দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এনেছে এমন প্রযুক্তির সমন্বয়, যা শুধু দেশের নয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনীয়। 
ক্যান্সার হাসপাতালের তথ্য মতে, গত এক বছরেই ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন অন্তত ১৫ হাজার রোগী। এর মধ্যে রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৯ হাজার ৬২৫ জন এবং হেমাটোলজি বিভাগ থেকে ২ হাজার ৭০৬ জন। রেডিথেরাপি চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচ শতাধিক। এখানে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার ও পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী বেশি। হেমাটোলজি বিভাগে সিএমএল (ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়া) লিম্ফোমা রোগীর সংখ্যা বেশি। অল্প সময়ের মধ্যে এটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের গরিব-অসহায় রোগীদের ভরসার ঠিকানায় পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এখানে রয়েছে বিনামূল্যে ও কম মূল্যে ক্যান্সার রোগীদের নানা চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ। গত এক বছরে পাঁচ শতাধিক রোগী এখান থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে ক্যান্সার হাসপাতালটি সাজানো হয়েছে। 
সর্বশেষ ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এ নতুন ১৬ শয্যার অত্যাধুনিক অনকো ক্রিটিক্যাল কেয়ার বা ক্যান্সার রোগীদের জন্য আলাদা আইসিইউ সংযোজন করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধসহ গুরুত্বর আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় দুই শতাধিককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের অনেকেই বিশেষায়িত এ হাসপাতালটি পরিদর্শন করে এটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সবাই এটির বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের সঠিক পরিকল্পনার আসল বাস্তবায়ন বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
বিশেষায়িত এই ক্যান্সার হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর রেডিওথেরাপি মেশিন। যার সফটওয়্যার ভার্সন ১৮; যা রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টতা ও
 কার্যকারিতায় অনন্য। এছাড়া ৪-ডি সি-টি সিমুলেটরের মাধ্যমে ক্যান্সার রোগীদের সর্বোচ্চ মানের সেবা দেয়া হচ্ছে, যা নিশ্চিত করে রোগ নির্ণয়ের সঠিকতা ও চিকিৎসার কার্যকারিতা। এই ইনস্টিটিউটের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো দেশের প্রথম অনকো-ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের আইসিইউ সেবা। এটি ক্যান্সার রোগীদের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে যখন তাদের প্রয়োজন পড়ে জটিল চিকিৎসার।
বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল অর্থের সংস্থান করা। এজন্য দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেককে চেয়ারম্যান করে ১০১ সদস্যের ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষের কাছ থেকে হাসপাতালের জন্য আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করেন। মানুষের টাকায় হাসপাতালটি গড়ে তুলতে যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সবাইকে নিয়ে ছুটে গেছেন হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম আজাদ। তিলে তিলে হাসপাতালটি গড়ার কার্যক্রমে শরিক হন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। নানা জটিলতা ও চ্যালেঞ্জের পরও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসহ সবাইকে নিয়ে হাসপাতালের জন্য টাকা সংগ্রহ করতে তারা দিন-রাতে ছুটে গেছেন অনেকের কাছে। এমনকি বিদেশে থাকা অনেক হৃদয়বান ব্যক্তির সাথেও যোগাযোগ করেন তারা। এক টাকা থেকে শুরু করে যে যেভাবে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আর এত কষ্টে গড়া হাসপাতালটি এখন পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের গরিব-অসহায় রোগীদের ভরসার ঠিকানা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতার পরও আজ ক্যান্সার হাসপাতালটি দৃশ্যমান। এটি এখন এই অঞ্চলের ক্যান্সার রোগীদের সম্পদে পরিণত হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল এটি।’ সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘আগে চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ছুটতে হতো। সামর্থ্য না থাকায় অনেকে ঢাকায় যেতে না পেরে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়তেন। তবে বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি চালু হওয়ায় এখন আর কাউকে ঢাকায় দৌঁড়াতে হয় না। এখানে এসে ক্যান্সারের সকল চিকিৎসা নিতে পারছেন সহজেই। ক্যান্সার হাসপাতালটি রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব।’
রেজাউল করিম আজাদ বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে ক্যান্সার হাসপাতালটি রোগীদের আস্থার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। এখানে কম খরচে ক্যান্সারের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ থাকায় এই অঞ্চলের অনেক এলাকা থেকে রোগীরা ছুটে আসেন। এমন কিছু রোগী এখানে আসেন যারা খুব গরিব। চিকিৎসা তো দূরে থাক ওষুধ কেনার টাকাও নেই তাদের। এসব রোগীদের আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিই। বিভিন্ন ফান্ড থেকে আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করি। চিকিৎসার অভাবে যাতে একজন রোগীও মারা না যায় সেটি নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। অনেকের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে মূল্যবান এই সম্পদটি চট্টগ্রামবাসীকে উপহার দিতে পেরে আমরা আনন্দিত।’ 
২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর ক্যান্সার হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সেই থেকেই এটি ক্যান্সার রোগীদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছে। এখানকার চিকিৎসা সেবা আন্তর্জাতিক মানের হলেও খরচ রাখা হয়েছে সাধ্যের মধ্যে। যেন অর্থাভাবে কেউ সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।
ফেনী থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়ের চিকিৎসা করাতে আসা গৃহিনী আকলিমা জান্নাত বলেন, ‘দুই বছর ধরে মেয়েটি ক্যান্সারে আক্রান্ত। ঢাকায় গিয়ে তার চিকিৎসা খরচ চালাতে জমি-জমা বিক্রি করে পথে বসে গেছি। এই অবস্থায় পরিচিত একজনের মাধ্যমে জানলাম মা ও শিশু হাসপাতালে কম খরচে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই মেয়েকে নিয়ে এখানে ছুটে এসেছি। হাসপাতালের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ওষুধসহ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। এমন সুযোগ আমার মতো গরিব-অসহায় অনেক পরিবারের জন্য অনেক বড় আশির্বাদ।’ 
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তথ্যমতে, চিকিৎসার অপ্রতুলতার কারণে চট্টগ্রামে প্রতিবছর ক্যান্সারে ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। টাকার অভাবে আক্রান্তদের একটি বড় অংশই থাকে চিকিৎসার বাইরে। দেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার সাড়ে ৭ শতাংশ। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি না ঘটলে ২০৩০ সালে এই হার ১৩ শতাংশে পৌঁছাবে। চট্টগ্রামে আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন ক্যান্সার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিচার্স সেন্টারটি দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যু হার কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 
রোগীদের সুস্থ করে তুলতে ক্যান্সার হাসপাতালটির রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ ও হেমাটোলজি বিভাগে রোগীদের সেবাসহ যাবতীয় কাজে নিয়োজিত আছেন ২৭ জন ডাক্তার ও ৫৩ জন নার্স। আর অনকো ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে কয়েক শিফটে দায়িত্ব পালন করেন ১০ জন ডাক্তার ও ৯ জন নার্স। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনায় বিশাল একটি টিম ক্যান্সার হাসপাতালের যাবতীয় বিষয় তদারকি করেন নিয়মিত। 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×