খালপাড়ে দুই হাজার ভবন
নগরীর বাকলিয়ার সৈয়দ শাহ সড়কে খালের ওপর আজিজ মঞ্জিল নামের ভবন। প্রশ্ন উঠেছে– চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ ভবন তৈরির নকশা পাস করল কীভাবে মো. রাশেদ
সারোয়ার সুমন
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪০
চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী নগরে ভবন নির্মাণের সময় আটটি বিষয়ে তদারকি করবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। একই সময়ে প্রণীত নগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) খালের পাড় থেকে ১২ ফুটের মধ্যে কোনো ধরনের স্থাপনা করা যাবে না বলে নির্দেশনা রয়েছে। কাগজে-কলমে এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব সিডিএ’র। অবৈধভাবে যাতে কেউ ভবন তুলতে না পারে সেটিও দেখার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু ঘুষ নিয়ে এ কাজগুলো ঠিকমতো করছে না তারা। উল্টো অবৈধ স্থানে ভবন তৈরি করতে তারা দিচ্ছে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র। অনুমোদন করছে নকশাও। নিয়মের বাইরে গিয়ে খালপাড়ে কিংবা নালা-নর্দমার ওপরে গড়ে ওঠা এসব ভবন উচ্ছেদ করতে গিয়ে পরে মাশুল গুনতে হচ্ছে সরকারকে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করতে হলে খালপাড়ে গড়ে ওঠা এমন দুই হাজার ভবন এখন উচ্ছেদ করতে হবে সিডিএকে। এ জন্য ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে সরকারকে আড়াইশ কোটি টাকা। অথচ সিডিএকে ম্যানেজ করেই এসব ভবন মালিকরা নিয়েছেন নকশা। তুলেছেন ভবন।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘একটি ভবনের ভূমি ছাড়পত্র থেকে শুরু করে ভবন ব্যবহারের আগ পর্যন্ত সিডিএ’র তদারকির দায়িত্ব রয়েছে। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে যদি ক্ষতিপূরণ দিতে তার দায়-দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। যারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ খালপাড়ে বহুতল ভবন কীভাবে গড়ে ওঠে– কারা এর অনুমোদন দিয়েছেন সেসব খতিয়ে দেখতে বলেন তিনি।
নগরের ৩৬টি খালকে ঘিরে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এসব খাল থেকে ইতোমধ্যে ৩ হাজার ১৭৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। খালপাড়ে সড়ক ও খাল সম্প্রসারণ করতে আরও দুই হাজার স্থাপনা পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে হবে তাদের। একাংশ উচ্ছেদ করার পর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে আরও তিন হাজার ভবন। সব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে প্রায় পাঁচ হাজার ভবন। নগরের গুলজার খালের পাড়ে পার্বতী ফকিরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, খাল খননের সময় ভবনের ভিতের মাটি খালে ধসে পড়ে তিন তলা দুটি, দুই তলা একটি ও একটি এক তলা মন্দির খালের দিকে কাত হয়ে যায়। পরে ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হয়। ভবনের বাসিন্দারা এখন টিনশেড ঘর তৈরি করে খালের পাড়ে ঠাঁই নিয়েছেন।
যা বলছে সংশ্লিষ্টরা : গুলজার খালের তিন তলা ভবনটির মালিক স্বপন দাশ এর আগে সমকালকে বলেন, ‘সিডিএ’র অনুমোদন নিয়ে পাঁচ বছর পূর্বপুরুষের ভিটায় ভবনটি নির্মাণ করেছি। মাসহ তিন ভাইয়ের পরিবার নিয়ে এখানে আমরা থাকি। খাল খনন কাজ শুরুর আগে ভবনের বর্ধিতাংশ ভেঙে দিয়েছিল সিডিএ। খাল খনন করতে পাড়ঘেঁষে লোহার পাত পুঁতার সময় ভাইব্রেশনে ভবনগুলোয় ফাটল দেখা দেয়। খাল খননের কাজ শুরু হলে ফাটল বড় হয়ে ভবন খালের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরে ভবনটি উচ্ছেদ করেছে সিডিএ। কিন্তু আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি।’
পাশের আরেকটি ভবনের মালিক রাখাল দাশ সমকালকে বলেন, ‘লোহার পাতগুলো পুঁতার সময় ফাটল দেখা দেওয়ায় আমাদের তিন তলা ভবনটি ভেঙে ফেলতে হয়েছে। সিডিএ কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। সেই জায়গায় এখন একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেছি। সেটিতেও ফাটল দেখা দিয়েছে।’
গত বছরের ১৮ জানুয়ারি খালের পাশে লোহার পাত পুঁততে গিয়ে নগরের চশমা খালে হেলে পড়েছে চারতলা একটি ভবন। আশপাশের একতলা ভবনগুলোতেও ফাটল দেখা দিয়েছে। ফেরদৌস প্লাজা নামের ভবনটির মালিক খোরশেদ আলম বাপ্পী বলেন, ‘এটা আমাদের পারিবারিক ভবন। ১৯৮৬ সালে নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯০ সালে সোয়া দুই কাঠার ওপর চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য ভবনের একাংশ আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। পরে খালের কাজ শুরু করলে ভবনটি হেলে পড়ে। এ জন্য পুরোটা এখন ভেঙ্গে ফেলছি।’
অবহেলার খেসারত আড়াইশ কোটি টাকা : চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৭ সালে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। যথাযথ সমীক্ষা করে প্রকল্পটি না নেওয়ায় বাস্তবায়নে গিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়। গতবছর প্রায় চার হাজার ৮০৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে ৮৯৪ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। সংশোধিত প্রকল্পে ৭৩ হাজার ৫৫৩ বর্গমিটার স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ব্যয় ধরা হয় ২৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অনাবাসিক ভবনের ক্ষতিপূরণ ব্যয় ধরা হয় এক কোটি টাকা এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ধরা হয় যথাক্রমে এক কোটি ও দেড় কোটি টাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, একটি ভবনের নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে ব্যবহার সনদপত্র দেওয়া পর্যন্ত আটটি ধাপে সিডিএ’র তদারকির দায়িত্বে রয়েছে। তার কোনটিই তারা করেন না। তাদের অবহেলার কারণে এসব ভবন গড়ে উঠেছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সরকারকে। এর দায় সিডিএ’র কর্মকর্তাদের নিতে হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈছা মো. আনছারী বলেন, ‘নকশা অনুমোদনের সময় স্থপতি ও প্রকৌশলীর প্রত্যয়ন পত্র নিতে হয়। যারা ভবনটি নির্মাণের তদারক করবেন। কিন্তু ভবন মালিকেরা সিডিএ’র কাছ থেকে নকশা অনুমোদন পাওয়ার পর আর কোন স্থপতি ও প্রকৌশলী রাখেন না। যার ফলে অবৈধ নির্মাণের সংখ্যা বাড়ছে। আবার জনবলের অভাবে সিডিএ’ও ঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না।’
- বিষয় :
- ভবন নির্মাণ