বিষ প্রয়োগে ধ্বংস মাতামুহুরীর মাছ
.
মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, চকরিয়া (কক্সবাজার)
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৮
পাহাড়ি ঢলের বালু জমে মাতামুহুরী নদীর শতাধিক মাছের বিচরণক্ষেত্র (কুম) ভরাট হয়ে গেছে। তার ওপর শীত মৌসুমে চলে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার। এতে মাতামুহুরীর মিঠাপানির মৎস্যভান্ডার ধ্বংস হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, শীত মৌসুমে নদীর পানি কমে যাওয়ার পর একশ্রেণির লোভী মৎস্য শিকারি মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন অংশে বিষ প্রয়োগ করে। এতে নদীর নিচের অংশের চিংড়িসহ হরেক প্রজাতির মাছ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভেসে ওঠে। পরে এসব মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করা হয়।
চকরিয়ার পরিবেশ সংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এম. মনসুর আলম রানা বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর মৎস্য প্রজনন বৃদ্ধির স্বার্থে বিষ প্রয়োগ বন্ধ করতে প্রশাসনের নজরদারি ও প্রচার-প্রচারণা জরুরি।’
জানা গেছে, অন্তত এক যুগ ধরে মাতামুহুরী নদীর আলী কদম, লামা ও চকরিয়া বিভিন্ন পয়েন্টে লোভী মৎস্য শিকারিরা শেষ রাতের দিকে বিষ প্রয়োগ করে। পরে বিষক্রিয়ায় ভেসে ওঠে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। আহরণ শেষে লোকজনের আনাগোনা শুরু হওয়ার আগেই তারা স্থান ত্যাগ করে। এরপরও স্থানীয় শিশু-কিশোররা মশারির জাল দিয়ে অবশিষ্ট মাছ সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মাতামুহুরী নদীতে বিষ প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে একসময়ের মিঠাপানির সুস্বাদু মৎস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত মাতামুহুরী নদী এখন কার্যত মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে।
চকরিয়া উপজেলা কাকারা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মৎস্য শিকারি শাহাদাত হোছাইন ও কফিল উদ্দিন জানান, আগে তারা নদী থেকে প্রচুর পরিমাণ চিংড়ি ও বেলে মাছ ধরতে পারতেন। বর্তমানে সারাদিন জাল টেনে বা বড়শি দিয়ে এক কেজি মাছও পাওয়া যায় না। বিশেষ করে চিংড়িসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ঘুণিয়া এলাকার পেশাদার জেলে সুশান্ত কুমার দাশ ও মনোজ কুমার দাশ জানান, তারা শীত মৌসুমে মাতামুহুরী নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতেন। তাদের পাড়ার অন্তত ২০-৩০ জন জেলে মাছ শিকার করতেন। কিন্তু এখন তাদের পক্ষে আর মৎস্য শিকারের মতো কোনো অবস্থা নেই।
সূত্র মতে, আলিকদম উপজেলার নোয়াপাড়া, রোয়াম্বুর মুখ, চৈক্ষং খালের মুখ, ভরির মুখ, লেফার ফাঁড়ি, লামার উপজেলার শিলের তুয়া, ছক বিল ছড়ি, ছাগলখাইয়া, বমু খালের মুখ, সিতার কুম, মিজ্জিরির কুম ও ফাইলা পাড়া, চকরিয়া উপজেলার মানিকপুর লম্বা ঘাট, ইয়াংছা খালের মুখ, ফাইতং খালের মুখ, উত্তর সুরাজপুর, ভিলেজার পাড়া, কাকারা, মাঝের ফাঁড়ি, ঘুণিয়ার কুম ও মাতামুহুরী সেতু সংলগ্ন এলাকায় বিষ প্রয়োগের ঘটনা বেশি ঘটে। আলীকদম উপজেলার সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, ‘উপজেলার কুরুবপাতা ইউনিয়নের পাহাড়িয়া এলাকা থেকে নদীটির উৎপত্তি হয়েছে। এ নদীতে প্রচুর মিঠাপানির মাছ ছিল। নদীতে মাছ শিকার করে অন্তত তিনটি উপজেলার ৫ শতাধিক জেলে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। একযুগ আগেও এসব জেলে নদীতে মাছ ধরে প্রচুর মাছ পেতেন। এখন আর সেদিন নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন করতে গিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে বর্ষায় বৃষ্টির সাথে পাহাড়ের বালু এসে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে আগে শতাধিক কুম (মাছের বিচরণক্ষেত্র) ছিল। কিন্তু বর্তমানে চর ছাড়া আর কিছুই দেখা মিলছে না। মূলত মাতামুহুরী নদী এখন
অনেকটা মৃতপ্রায়।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, মাতামুহুরী নদীর দৈর্ঘ্য ২৭৭ কিলোমিটার। নদীটি চার উপজেলার জন্য আশির্বাদ। নদীর মিঠাপানি দিয়ে হাজার হাজার একর জমিতে ইরি-বোরো ও সবজি চাষ হয়ে থাকে। যেভাবে মাতামুহুরী নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে নদীর পানি ও মাছ দুটিরই অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
চকরিয়া উপজেলার সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা আনোয়ারুল আমিন বলেন, ‘নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মৎস নিধনের ঘটনা সত্য। তবে দীর্ঘ নদীতে কখন, কোথায়, কিভাবে, কারা বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন করছে তা শনাক্ত করা কঠিন। এছাড়া বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে শেষ রাতে যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। অথচ মৎস বিভাগ মাতামুহুরী নদীতে মাছের বংশবিস্তারের জন্য প্রতি-বছর জুলাই-আগষ্ট মাসে মাছের পোনা অবমুক্ত করে।’
- বিষয় :
- মাছ