ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রতিবন্ধী সাইকা স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ, চাওয়া একটি চাকরি

কলেজে আসা-যাওয়া আর পড়াশোনায় দিনে লাগত ১২ ঘণ্টা

কলেজে আসা-যাওয়া আর পড়াশোনায় দিনে লাগত ১২ ঘণ্টা

পড়াশোনায় ব্যস্ত শারীরিক প্রতিবন্ধী সাইকা আসমা সানমুন সমকাল

ইকবাল হোসেন মনজু, ফটিকছড়ি

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:০০

সাইকা আসমা সানমুন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে দারুণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিন ফুট উচ্চতার এ মেয়েটি অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে তাক লাগানো রেজাল্ট করে প্রশংসায় ভাসছেন। তার সাফল্যে খুশি পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশীসহ কলেজের শিক্ষকরা।  
আসমা চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের পূর্ব পাশে প্রফুল্ল ডাক্তার বাড়িতে। বাবা আবু সালেহ চৌধুরী পেশায় একজন ব্যবসায়ী। মা মাজেদা বেগম তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মেয়ের সাফল্যের কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘ওর এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠেনি সে। এই সবকিছুর জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে আমাদের।’
 তিনি আরও বলেন, ‘আগে সংগ্রাম ছিল তার পড়াশোনা শেষ করানোর, আর এখন একমাত্র ইচ্ছা মেয়ের একটা ভালো চাকরি হোক। আমাদের অবর্তমানে যেন সে নিজেকে নিজে চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে।’
সাইকা আসমা বলেন, ‘স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পেছনে আমার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আম্মু-আব্বু। তারা আমার বেঁচে থাকার শক্তি। শত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে আম্মু-আব্বুর অনুপ্রেরণায় আমার এতদূর আসা। অনেক সমস্যা দূরে রেখে আব্বু-আম্মু আমার পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে গ্রাম ছেড়ে অচেনা ব্যস্ত নগরীতে আমি উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে পেরেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার আব্বু আমার পড়াশোনার জন্য কলেজে আনা-নেওয়ায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন আম্মুর কাঁধে, আর সংসারের সবকিছু সামলেছেন তিনি। আগে কখনও আব্বুকে ছাড়া এলাকার বাইরেও যাওয়া হতো না; সেই অবস্থায় আমি আর আম্মু কলেজে যাতায়াতের জন্য চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করেছি।’
সাইকা বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে আব্বুর সঙ্গে থাকতে না পারলেও তার পূর্ণ সহযোগিতাই ছিল আমার শক্তি। কলেজে আসা-যাওয়ায় আমাদের প্রায় ১২ ঘণ্টা লেগে যেত। সকাল ৬টায় বের হলে রাত ৯টায় বাসায় ফিরতাম। আমি ভেতরে ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আম্মু ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করত। আমার সহপাঠীরা আমাকে বলত, আন্টি যে তোমাকে নিয়ে এভাবে সারাদিনের জন্য চলে আসে বাসার কাজ কে করে? আসল বিষয়টা হল-বাসার সব কাজ শেষ করে আম্মু আমাকে নিয়ে কলেজে আসতেন, আবার বাসায় ফিরে বাকি কাজ সারতেন। শত পরিশ্রমের পরও আমার আম্মুর চোখে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ছিল না। আমার স্বপ্নময়ী আম্মু। আমার এ সাফল্য আমার নয়, আমার আম্মু-আব্বুর।’
সাইকা আসমা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের মত শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সমাজে অন্য চোখে দেখা হয়। শিক্ষিত মানুষেরা এটি আরো বেশি করে। কেন আমার মধ্যে কী এমন আছে যে এভাবে দেখতে হবে? আমরা যারা শিক্ষিত হয়েছি সরকার তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করুক এবং যারা শয্যাশায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধী আছে তাদের ভাতা দেয়া হোক।’
‘আমি বলছি না আমাকে ক্যাডার হতে হবে, আমার যে সীমাবদ্ধতা আছে তার ভেতরে থেকেই তো কাজ করতে পারি। তাও অনেকে বলে আপনার সাথে কাজ করতে আমাদের সমস্যা হবে।’–যেগ করেন সাইকা আসমা।
প্রতিবেশি ফারহানা বলেন, ‘আমরা দেখেছি কী কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বাবা-মা সাইকাকে বড় করেছে। আজকে এ পর্যন্ত আসার পেছনে তাঁদের বড় অবদান। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তো আছে, তাকে এ সাফল্য লাভের জন্য অগ্রাহ্য করতে হয়েছে সমাজের নানা রকম প্রতিবন্ধতাকেও। অনেক সময় তাকে নিয়ে বের হলে লোকজন নানা কটু কথা বলত। এটা দেখে মানুষ হিসেবে আমরাও লজ্জিত হতাম। সাইকা স্নাতক পাস করেছে, এখন আশা- তার যেন একটা ভালো চাকরি হয়।’
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আসমা দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছাশক্তি ও মনোবল শক্ত থাকলে শারীরিক প্রতিবদ্ধকতা কোন সমস্যা না। তার চাকরির ইচ্ছা যাতে পূরণ হয় সে জন্য আমার পক্ষ থেকে সর্বাত্নক সহযোগিতা থাকবে।’

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×