ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

সুকৌশলে লোপাট সুফল প্রকল্পে

সুকৌশলে লোপাট সুফল প্রকল্পে

চুনতি সাতগড় বিটের একটি পাহাড়ে সুফল প্রকল্পের সাইনবোর্ড আছে কিন্তু গাছের চারা নেই সমকাল

কাইছার হামিদ, লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম)

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৩

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি রেঞ্জের সাতগড় বনবিটের অধীনে সুফল প্রকল্পের বনায়নে ‘সুকৌশলে টাকা লোপাটের’ অভিযোগ উঠেছে বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের অধীনে ৪০ হেক্টর বনের জায়গায় ১ লাখ মিশ্র প্রজাতির দ্রুতবর্ধনশীল চারা রোপণের সাইনবোর্ড লাগানো হলেও বাস্তবে ১০-১২ হেক্টর বনে মাত্র ২৫ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে।  
অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে চুনতি রেঞ্জ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান কোনো তথ্য দিতে বা কথা বলতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘আমি এখানে সম্প্রতি যোগদান করেছি। বাগান সৃজনে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে।’
সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, চুনতি সাতগড় বনবিটের পূর্ব পাশের তেরপোলা, কইন্যারতলী, বড়তলীর দক্ষিণে তথা বাগপাচা ঝিরি পর্যন্ত যেসব বাগান করা হয়েছে তার হিসাব শুধু কাগজে-কলমে ও সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধ। সাইনবোর্ডে বাগানের চারার সংখ্যা ও গাছের প্রজাতির কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বাগানের সাইনবোর্ডে গামার, চিকরাশি, আকাশমণি, পিতরাজ, ধারমারা, সোনালু, কাজুবাদাম,  ছাতিয়ান, সিভিট, রক্তচন্দন, খয়ের, আমলকী, হরীতকী, বহেরা, অর্জুন, কাঞ্চলভাদী, নিম, বকাইন, শিমুল, পলাশ, কাঞ্চন, চাকুয়া কড়ই, তেতুয়া কড়ই, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির এক লাখ গাছের চারা লাগানোর কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বেশিরভাগ বনে লাগানো হয়েছে আকাশমনি ও অন্যগাছ। 
নার্সারিতে কাজ করা আব্দুর রহিম জানান, নার্সারিতে ব্যবহার করা হয়েছে সাতগড় বনবিট অফিসের পিছনের পাহাড়ের মাটি, খুটি হিসেবে পাহাড়ের বাঁশ কাটা হয়েছে। এসব ঠিকাদার কর্তৃক সরবরাহ থাকার কথা থাকলেও সরবরাহ করেছের তখনকার বিট অফিসার রফিকুল ইসলাম। এখানে কাগজে–কলমে ঠিকাদার থাকলেও বাস্তবে কাজ করেছেন বিট অফিসার রফিকুল।
সরেজমিন দেখা যায়, কোন জায়গায় বাগানের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চারা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক গাছের চারা প্রথম বছরেই মারা গেছে। দ্বিতীয় বছরে সার দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সুফল প্রকল্পের বনায়ন অংশীদার নিয়োগেও প্রতিজনের কাছ থেকে ৩০/৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে তৎকালীন বিট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। অংশীদারদের দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে  বাগান সৃজনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।
অভিযোগ রয়েছে, বনায়নে জৈব সার, রাসায়নিক সার ও প্রতিটি গাছের সাথে খুটি লাগানোর নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। বনায়নের চিকরাশি, গামার, আকাশমনি, চাতিয়া,  করই, বহেরা, অর্জুন গাছ লাগানোর নির্দেশনা থাকলেও তা যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি। 
অপরদিকে ৬ ফুট অন্তর চারা রোপণের কথা থাকলেও একেকটি চারার দূরত্ব করা হয়েছে ১০ থেকে ১২ ফুট। চারা রোপণের আগে গোবর সার ও রাসায়নিক সার দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। আর এ কারণেই গত অর্থবছর করা বাগানের প্রায় ৭০  শতাংশ চারা ইতিমধ্যে মারা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাগান অংশীদার ব্যক্তি বলেন, ৪০ হেক্টর বাগান করার কথা থাকলেও প্রায় ৩০ হেক্টরে কোন বাগানই করা হয়নি। বরাদ্দকৃত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ও সহযোগীরা। দিনমজুর দিয়ে কাজ করানোর ক্ষেত্রেও জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের দৈনিক ২৫০/৩০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে মাস্টার রোলে ৫০০–৬০০ টাকা দেখানো হয়েছে। 
জানা গেছে, শ্রমিকদের দিয়ে মাটি কাটা, ব্যাগে মাটি ভরা ও ব্যাগে বীজ দেয়ার কাজও করানো হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বাগান করার সময় শ্রমিক ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। সে মোতাবেক সারাবছর এসব দিনমজুর ও শ্রমিকদের কাজ করার কথা। পাশাপাশি শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)সংরক্ষণসহ মাস্টার রোলে সই/স্বাক্ষর রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শ্রমিকদের কোন এনআইডি না থাকলেও সংশ্লিষ্ট বনবিট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ভুয়া এনআইডি নম্বর ও নাম ঠিকানা দিয়ে কাজ করিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের সহকারী বনসংরক্ষক দেলোয়ার হোসেনের যোগসাজশে বনায়নে টাকা লোপাট হয়েছে। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বনবিট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বেপরোয়া ছিলেন। 
স্থানীয় সাঈদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সুফল প্রকল্পের যে টাকা বিশ্বব্যাংক দিয়েছে তা ঋণ হিসেবে দিয়েছে। যদি এভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়, সেই ঋণের দায়ভার কি বনবিভাগ বহন করতে পারবে?’
এ বিষয়ে সহকারী বনসংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বনায়নে কোন অনিয়ম হয়নি। বনায়নের সময় কাজ পরিদর্শন করা হয়েছে। ৪০ হেক্টরের জায়গায় ৪৬ হেক্টর বনায়ন করা হয়েছে। তবে বনায়ন করতে গেলে ২০ শতাংশ চারা নষ্ট হয়। তা পরের বছর পূরণ করে দেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘চুনতি রেঞ্জের সাতগড় বনবিটের অধীনে সুফল প্রকল্পের বনায়নে অনিয়মের বিষয়টি তদন্তাধীন।’
 

আরও পড়ুন

×