৬০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, তদন্তে দুদক
.
আহমেদ কুতুব
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৮
চট্টগ্রাম থেকে থেকে দুবাই, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে ৬৫ লাখ ২২ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হলেও, তিন দেশ থেকে কোনো ডলার দেশে আসেনি। ইমো ট্রেডিং নামের একটি কথিত কোম্পানি আমদানি-রপ্তানিতে পদে পদে জালিয়াতি ও প্রতারণা করেছে। দেশের প্রায় ৬০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে দুদক। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকে জমা দেওয়া রপ্তানি তথ্যের সঙ্গে কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্যের কোনো মিল নেই। কাস্টমস ও বন্দরে জালিয়াতি করে ২৭৯টি পণ্য চালানে ইমো ট্রেডিং ২ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করলেও, পণ্য বিক্রির ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার দেশে আসার কোনো প্রমাণ পায়নি কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
বিদেশে পণ্য রপ্তানিতে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আরেক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার, জাল রপ্তানি দলিল তৈরি, বিধিবহির্ভূতভাবে বিশেষ রপ্তানি কোড ব্যবহার, বিল অব এক্সপোর্টে ভুয়া এক্সপোর্টারের নাম, ইমপোর্টারের নাম, এলসি নম্বর ব্যবহারের মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন। ঢাকার দক্ষিণখানের জব্বার মার্কেটে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইমো ট্রেডিংয়ের ঠিকানায় সরেজমিন তদন্তে গিয়ে এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাননি কাস্টমস গোয়েন্দারা। ইমো ট্রেডিং ছাড়াও চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানও এ ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস।
দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপপরিচালক আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আদালত থেকে সম্প্রতি মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। আদালতের নির্দেশ মতো আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সজীব দেবনাথ বলেন, ‘২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউসে ইমো ট্রেডিং ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইম্যাক্স শিপিং লিমিটেড পরস্পর যোগসাজশে পণ্য রপ্তানিতে একের পর এক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। রপ্তানি দলিল জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি ও দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষতিসাধন করেছে। মিথ্যা ঘোষণা ও ভুয়া দলিল তৈরি করে জালিয়াতির মাধ্যমে ২৭৩টি পণ্যচালান রপ্তানি করলেও তার বিপরীতে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসেনি।’
রপ্তানিকারক ইমো ট্রেডিংয়ের মালিক আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমরা কোনো অর্থ পাচার করিনি। জালিয়াতিতেও জড়িত নই। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইম্যাক্স শিপিংয়ের মালিক বিএনপি নেতা সরফরাজ কাদেরকে ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।’
আদালত সূত্রে জানা যায়, জাল-জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের মামলাটি তদন্ত কর্মকর্তা শুরু করেন বন্দর থানার ইন্সপেক্টর বাবর মিয়া। তারপর আসামিপক্ষ হাইকোর্টে যান। হাইকোর্ট পুলিশ থেকে তদন্তভার নিয়ে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই আলোকে গত ১৩ নভেম্বর মামলার নথি থানা পুলিশ থেকে দুদকের হাতে স্থানান্তর করা হয়। তারপর তদন্ত শুরু করে দুদক।
কাস্টম সূত্র জানায়, ইমো ট্রেডিং রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করলেও বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসেনি। এ তথ্য পেয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম পর্যালোচনা করে ইমো ট্রেডিং নামের প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালে ৭৪টি, ২০২২ সালের ১৭৭টি এবং ২০২১ সালের ২৮টি পণ্য রপ্তানির বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য পায়। এই বিল অব এক্সপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে বিল অব এক্সপোর্ট ও ইএক্সপিতে উল্লেখ থাকা তথ্য ও প্রমাণ দেখে ইমো ট্রেডিংয়ের রপ্তানি জালিয়াতির সত্যতা পায়। এ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালের ৭৪টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে ১৯ লাখ ৭০ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার, ২০২২ সালের ১৭৭টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে ৪৪ লাখ ১৮ হাজার
৭১৪ ডলার এবং ২০২১ সালের ২৮টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৭৯ মার্কিন ডলার সর্বমোট ৬৫ লাখ ২২ হাজার ৫৯৪ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানির তথ্য উঠে আসে। তিন দেশে ২৫২৩ মেট্রিক টন টি-শার্ট, ট্রাউজার, ট্রাংক টপ রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর তদন্ত কমিটি চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংক ঢাকার মতিঝিল বৈদেশিক বাণিজ্য কর্পোরেট শাখায় চিঠি দিয়ে ইমো ট্রেডিং এর ২৭৯টি পণ্য চালান রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে কিনা জানতে চান। ব্যাংক থেকে ৬ মার্চ কাস্টমস গোয়েন্দাকে জবাবি চিঠি দেওয়া হয়। ব্যাংক ২৭১টি বিল অব এক্সপোর্টের ইএক্সপির মধ্যে মাত্র ১৪টি ইমো ট্রেডিংয়ের অনুকূলে ইস্যুকৃত বলে জানান। বাকি বিল অব এক্সপোর্টের ইএক্সপির তথ্য ও বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য অসামাঞ্জস্য পূর্ণ অর্থাৎ এগুলো ইমো ট্রেডিংয়ের নামে নয়। ২৭১টির মধ্যে ২৫৭টি ইএক্সপিই ভিন্ন ভিন্ন রপ্তানিকারকের অনুকূলে ইস্যু করা। এছাড়া অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম হতে প্রাপ্ত বিল অব এক্সপোর্টের তথ্যের সাথে এক্সপোর্টারের নাম, ইমপোর্টারের নাম, ইনভয়েস ভ্যালো, পোডাক্টস ডেসক্রিপশন, এলসি নম্বর ব্যাংক থেকে প্রেরিত ইএক্সপির তথ্যের সাথে কোন মিল পাওয়া যায়নি বলে জানায় ব্যাংক।
কাস্টমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা আমেনা বেগম সরেজমিনে ইমো ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের ঢাকার দক্ষিণ খানের জব্বার মার্কেটের ঠিকানায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধনে উল্লেখিত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেও তাদের হদিস পাওয়া যায়নি। যদিও প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত অনলাইনে মুসক দাখিল করেন। মুসক নিবন্ধন মোতাবেক ইমো ট্রেডিং (বিন; ০০৩৪৫০১৭৭-০১০২) জব্বার মার্কেট, দক্ষিণ খান বাজার, ঢাকা। সোনালী ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্য কর্পোরেট শাখা ব্যাংক হিসাব নম্বর ১৬০৮৯৩৩০৩১৫৫১ উল্লেখ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সাল হতে অধ্যাবধি কোন আমদানি করেনি। অ্যাসাইকুডা ওয়াল্ড সিস্টেম হতে প্রাপ্ত ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ২৭৯টি বিল অব এক্সপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালে ২৮টি বিল অব এক্সপোর্ট, ২০২২ সালের ১৭৭টি ও ২০২৩ সালে ৭৪টি সর্বমোট ২৭৯টি বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে বিল অব এক্সপোর্টের ৩৭ নম্বর ফিল্ড এ সিপিসি ১০০ এবং ২৪ নম্বর ফিল্ড এ ২০ পাওয়া যায় ২৭৩টি। তার মধ্যে ১০৬টি বিল অব এক্সপোর্টের ইজিএম পাওয়া যায়নি। বাকি ১৬৭টি বিল অব এক্সপোর্টের ইএক্সপির তথ্য ও বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য অসামঞ্জুস্যপূর্ণ। ২৭৩টি বিল অব এক্সপোর্টের মধ্যে ১৪টি ইএক্সপি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ইস্যু করা হলেও বিল অব এক্সপোর্টের ইএক্সপির তথ্য ও বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য অসামঞ্জুস্যপ্তূর্ণ। বাকি ২৫৯টি ইএক্সপি ইমো ট্রেডিং নয়, ভিন্ন ভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যুকৃত। যেহেতু একটি বিল অব এক্সপোর্ট একাধিকবার ইএক্সপি ব্যবহারের সুযোগ নেই, সেহেতু উক্ত ২৭৩টি বিল অব এক্সপোর্টে ইএক্সপি ব্যবহার করা হলেও ফাইলড-২৪ নেচার অব ট্রানজেকশন এ কোড ২০ ব্যবহার করার কারণে ইএক্সপি ও সংশ্লিষ্ট বিল অব এক্সপোর্ট অটো ম্যাচ হয়নি। তাই উক্ত বিল অব এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে ইএক্সপির কার্যকারিতা নেই। ফলে ইমো ট্রেডিং ২৭৩টি পণ্য চালানের বিপরীতে বৈধ পন্থায় বৈদেশিক মুদ্রা ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার দেশে আসার সুযোগ নেই। অস্বিত্বহীন প্রতিষ্ঠান বিদেশে পণ্য পাঠালেও দেশে বিপুল পরিমাণ মার্কিন ডলার দেশে না এনে মানি লন্ডারিং করেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ঘটনায় ইমো ট্রেডিং ও সিএন্ডএফ এজেন্ট লাইমেক্সের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরের বন্দর থানায় ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল জাল-জালিয়াতি ও কাস্টমস আইনে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- রপ্তানিকারক ইমো ট্রেডিংয়ের মালিক আব্দুল কাদের, সিএন্ডএফ এজেন্ট লাইমেক্স শিপার্সের মালিক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের, সাদাব মকবুল, কাস্টমস সরকার ওবায়দুর রহমান ও তরুণ কান্দি দে। আবদুল কাদের ঢাকা দক্ষিণ খানের বাসিন্দা, সরফরাজ কাদের চট্টগ্রামের দক্ষিণ হালিশহরের সেইলার্স কন্ট্রাক্ট রোডের বাসিন্দা।
- বিষয় :
- দুদক