ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

মিলেমিশে পাহাড় সাবাড়

মিলেমিশে পাহাড় সাবাড়

ঝরঝরে হয়ে আছে পাহাড়ের মাটি। বৃষ্টি এলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ছবিটি চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর এলাকা থেকে তোলা সমকাল

 আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:০৭

রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি যমুনার ম্যানেজার (প্রশাসন) হিসেবে চাকরি করেন খায়রুন নেছা। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও তিনি চট্টগ্রামের জঙ্গল লতিফপুরে কেটেছেন দেড় হাজার ঘনফুট পাহাড়। নিষিদ্ধ হলেও পাহাড় সাবাড় করতে দ্বিধা করেননি শীর্ষ এ কর্মকর্তা। পরিবেশ অধিদপ্তরের পাহাড়খেকোর তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে তাঁর নাম। টিনের বেড়া দিয়ে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫ ফুট উচ্চতার পাহাড়টিকে চুক্তিতে ধ্বংস করেছে লাল মহিউদ্দিন সিন্ডিকেট। 
সুদূর দুবাই প্রবাসী আবদুল জলিলের সঙ্গে চুক্তিতে চট্টগ্রামের জঙ্গল লতিফপুরের মিরপুর রোডে এনাম ড্রাইভারের বাড়ির পেছনে ৫৬ হাজার ঘনফুট পাহাড় কেটে সাবাড় করে রনি সিন্ডিকেট। ৭০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৮ ফুট প্রস্থ ও ১০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়টি খাড়াভাবে কেটে প্লট করা হয়। তিন মাস ধরে চলে পাহাড় ধ্বংসের আয়োজন। একইভাবে দেড় হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটেন নগরের সিঙ্গাপুর মার্কেটের ব্যবসায়ী মঈন উদ্দিন আহমেদ। জঙ্গল লতিফপুর সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ব্যবসায়ী জামাল ও সাধারণ সম্পাদক আক্তারের বিরুদ্ধে পাঁচটি পাহাড় কাটায় নাম জড়িয়েছে। মিরপুর হাউজিং সোসাইটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ও সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে প্লট তৈরি করেছেন। 
চট্টগ্রামে এভাবে একের পর এক পাহাড় সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী কারও হাত থেকেই রক্ষা পাচ্ছে না। রাতে-দিনে চলছে পাহাড় নিধন। পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালালে কিছুদিন বন্ধ থাকে, তারপর আবার বেড়া দিয়ে রাতে-দিনে চলে পাহাড় কাটা। পাহাড় মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে আটজনের দুটি সিন্ডিকেট বেপরোয়াভাবে পাহাড় কাটায় জড়িত। চট্টগ্রামে পাহাড় নিধন বন্ধ করতে না পারার পেছনে ১১টি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ হলে পাহাড় নিধন বন্ধ সম্ভব বলে মত দিয়েছে সংস্থাটি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের রিসার্চ অফিসার আশরাফ উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ঠেকানো যাচ্ছে না অনেকগুলো কারণে। এসব কারণ চিহ্নিত করে সমাধান চেয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। সমস্যাগুলো সমাধান হলে পাহাড় নিধন ঠেকানো অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। তারপরও আমরা এখন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে মামলা করছি।
অভিযুক্ত খায়রুন নেছা বলেন, তিন-চার মাস আগে এক প্রবাসীর কাছে পাহাড়টি বিক্রি করে দিয়েছি। বিক্রির পর তারা পাহাড়ে কী করেছে, তা জানা নেই। প্রবাসীর ভাই ও স্বজনরা পাহাড়টি দেখাশোনা করছেন। পাহাড়ের মালিকানা যেহেতু আমাদের নামে ছিল, তাই পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটা মামলায় আসামি করেছে।
জঙ্গল লতিফপুর সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন বলেন, সমিতির সদস্যরা প্লট কিনে কেউ পাহাড় কাটলে আমাদের নামে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দিয়ে দিচ্ছেন। আমরা পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত নই।
নানা প্রতিবন্ধকতা 
চট্টগ্রামে পাহাড় নিধন ঠেকানো যাচ্ছে না ১০ প্রতিবন্ধকতার কারণে। এর মধ্যে অন্যতম রেকর্ডে পাহাড় কিংবা টিলা শ্রেণি থাকলেও সরকারি খতিয়ানেই আবার সেই ভূমির শ্রেণি ছনখোলা, খিলা, নাল ও বাড়ি, কারখানা, বাগান উল্লেখ থাকায় আদালতে কঠিন জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে পরিবেশ কর্মকর্তাদের। দুই প্রতিষ্ঠানে দুই তথ্য থাকায় আসামিরা পাহাড় কেটেও খালাস পেয়ে যান। পাহাড়খেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে কর্মীরা ব্যক্তিগত শত্রুতার শিকার হন। 
এ ছাড়া পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতরা সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যু হওয়ায় স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা মুখ খোলেন না। কেউ সাক্ষী দিতে রাজি হন না। আদালতে সাক্ষীর অভাবে মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। মামলা দায়ের ও চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব সিডিএমএস সফটওয়্যার না থাকায় পোহাতে হয় ভোগান্তি। পাহাড়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি ভাতা না থাকায় কর্মরত অফিসারদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার উৎসাহ কম। 
চুক্তিতে পাহাড় কাটা 
জঙ্গল লতিফপুর, মিরপুর ও লইট্টাঘোনা এলাকায় পাহাড় কাটায় জড়িত আট সদস্যের দুটি সিন্ডিকেট। পাহাড় মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে তারা পাহাড় কেটে রাস্তা ও প্লট নির্মাণ করে দেয়। অনেক পাহাড় মালিক নিজস্ব বাড়ি করেন। আবার কেউ কেউ প্লট করে বিক্রয় করেন। সিন্ডিকেটের মূলে রয়েছে মো. রনি ও লাল মহিউদ্দিন। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন মো. ওসমান, জামাল উদ্দিন, আবুল কাসেম, মো. মানিক, সবুজ ও মো. ইয়াছিন। 
রনি বলেন, পাহাড় মালিকের চাহিদা অনুযায়ী বেতনের বিনিময়ে কাজ করি। আগে পাহাড় কাটলেও এখন কাটছি না।
৮ কর্মকর্তার কাঁধে ৩২ উপজেলা-থানার দায়িত্ব
জনবল সংকটের কারণে পাহাড় কাটা রোধ, মামলা দায়ের ও সঠিকভাবে তদন্ত করে চার্জশিট দাখিলে বেগ পেতে হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরকে। চট্টগ্রাম জেলায় ১৫টি উপজেলার দায়িত্বে মাত্র তিনজন কর্মকর্তা। মহানগরের ১৫ থানার দায়িত্বে আছেন মাত্র পাঁচজন। প্রতিটি উপজেলার পাহাড় কাটা বন্ধ, নানা ধরনের পরিবেশগত সমস্যা ও ছাড়পত্র অভিযোগসহ তাদের আবার দাপ্তরিক কাজও করতে হয়। ফলে জনবল সংকটের কারণে পাহাড় নিধনের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।  

আরও পড়ুন

×