
দুবাইয়ের আবরা ঘাট; এখানে নৌকাচালকদের অধিকাংশই বাংলাদেশি-সংগৃহীত
কয়েক মিনিট পরপরই যাত্রীবোঝাই করে ছুটে চলছে ছোট ছোট নৌকা। এ দৃশ্য চোখে লেগে থাকার মতো। ডিঙির আদলে বানানো হলেও এগুলো ডিঙি নৌকা থেকে কিছুটা ভিন্ন। এর উপরে রয়েছে দোচালা ছাউনি, যা রোদ-বৃষ্টি থেকে যাত্রীদের রক্ষা করে। তা ছাড়া এর পাটাতনও ডিঙি নৌকার থেকে উঁচু, মাঝখানে সুন্দর করে বেঞ্চের মতো বানানো হয়েছে বসার জায়গা। তার দু'পাশে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসেন যাত্রীরা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ের প্রাণকেন্দ্র চিড়ে বয়ে চলা নদী পারাপারে আবহমানকালের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে কাঠের তৈরি এসব নৌকা। স্থানীয়দের কাছে নদীটি 'দেরা ক্রিক' নামে পরিচিত। আর নৌকাগুলোকে আরবিতে বলা হয় 'আবরা'। মূলত নদীর দুই পাড়ে (দেরা ও বার দুবাই হিসেবে পরিচিত) আবরা ঘাটে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা ভিন্নরূপে দুবাইকে দেখতে পান। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা ছুটে যান সেখানে। নদী পারাপারে নৌকার ভাড়াও বেশি গুনতে হয় না যাত্রীদের। মাত্র এক দিরহাম হলেই চলে। এ কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ও যাত্রী এখানে ভিড় করেন। আর এতে করে জীবিকার মন্ত্র খুঁজে পান এ পেশায় নিয়োজিত প্রবাসীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাজের জন্য ভিনদেশ থেকে আসা ব্যক্তিরা স্থানীয়দের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এসব নৌকা চালান। এখানকার নৌকাচালকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই বাংলাদেশি। যাত্রীদের পারাপারের জন্য 'ওল্ড সুক দুবাই', 'বার দুবাই' ও 'আবরা সার্ভিস স্টেশন' নামে দেরা ও বার দুবাইয়ে রয়েছে আলাদা তিনটি স্টেশন। এখানে বর্তমানে মোট নৌকার সংখ্যা ১৪৯। একেকটি নৌকায় নিয়মিত দু'জন করে চালক থাকেন।
পর্যটকদের কাছেও দুবাইয়ের আবরা ঘাট বাড়তি আকর্ষণের জায়গা। অর্থনৈতিকভাবে বিত্তশালী দেশটি যেখানে বড় বড় সেতু নির্মাণ করে রেখেছে সেখানে ছোট্ট এই নদীটির ওপর কোনো সেতু নেই। বহুকাল ধরেই এখানে চলছে নৌকায় যাত্রী পারাপার।
সেতু না হলেও আরব্য ঐতিহ্যের ধারকবাহক হিসেবে নদীটির দুই পাড়ে সংস্কার ও শোভাবর্ধনের নানা উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আবরা স্টেশনগুলো ঘিরে নানা সময় হয়েছে উন্নয়ন কাজ। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বন্দরের মালপত্র ওঠানামার কার্যক্রম।
সরেজমিন দেখা গেছে, দেরা ও বার দুবাই স্টেশন থেকে প্রতি দুই মিনিট পরপর নৌকাগুলো ছেড়ে যায়। কোনোটি পাড়ে আসছে আবার কোনোটি যাত্রী নিয়ে ছুটছে গন্তব্যে। প্রতিবার যাতায়াতে একেকটি নৌকা ৮-১০ জন যাত্রী ধারণ করে। গত একদশকেও ভাড়া বাড়েনি, সেই এক দিরহামই রয়েছে। তবে বদলেছে চালকদের চুক্তি ও কাজের ধরন। নৌকা পারাপারের কাজ করছেন আড়াইশ থেকে তিনশ প্রবাসী বাংলাদেশি। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত যাত্রী ওঠানামা করান তারা। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে আবরাচালক হিসেবে বৈধ ভিসা।
চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশিদের মধ্যে অধিকাংশের বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। তাদের কেউ কেউ এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বিশ থেকে পঁচিশটি বসন্ত। কেউ কাজ করছেন স্থানীয় আরবিদের সঙ্গে, কেউবা বাঙালি মালিকানাধীন নৌকায়।
কয়েকজন চালক জানান, কক্সবাজারের বাসিন্দা হিসেবে পাসপোর্ট ব্যবহারকারী কয়েকজন রোহিঙ্গাও রয়েছেন এখানে। যারা নানা কায়দায় আমিরাত এসে কাজ নিয়েছেন।
কক্সবাজারের বালুখালীর বাসিন্দা আবু সিদ্দিক সমকালকে বলেন, 'আমরা এখানে আছি ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নৌকা চালাই। প্রতিবারে ১০-১২ জন যাত্রী ওঠে নৌকায়। তবে করোনার কারণে যাত্রী কমে যাওয়ায় আয়ও কমে গেছে। যাবতীয় খরচ শেষে এখন তেমন কিছু থাকছে না। তবুও চলছি, বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছি।'
চালক আমিন উল্লাহ বলেন, স্থানীয় আরবিদের নৌকাগুলোতে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতে হয়। আবার কতকগুলো আছে বাঙালি মালিকানাধীন। একেক নৌকায় কাজের ধরনও একেক রকম। কেউ মাসিক বেতন, কেউ দৈনিক, কেউবা সমান সমান লাভ বণ্টন চুক্তিতে কাজ করেন।
কক্সবাজারের মোহাম্মদ কাসেম নামের আরেকজন চালক বলেন, একটি নৌকায় দু'জন করে চালক থাকেন। একজন ছুটিতে গেলে অন্যজনকেই দু'জনের কাজ করতে হয়।
মন্তব্য করুন