
স্পেনের এনকারেজ পার্বত্য এলাকার 'প্যালোজা'
ইউরোপ বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উঁচু অট্টালিকা, সুদৃশ্য ভবন, আলো ঝলমলে শহর। তবে ইউরোপেও রয়েছে কোলাহলমুক্ত সুনসান গ্রাম। আছে শত শত বছর আগের ঘরবাড়ি। প্রতিকূল পরিবেশে কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে টিকে আছে বহু মানুষ। স্পেনের এনকারেজ পার্বত্য এলাকায় আছে এমনই কিছু গ্রাম। এসব গ্রামে অনেক ঘর আছে, যেগুলো দেখতে একেবারেই অন্যরকম। পাহাড়ের পাদদেশে এ ঘরগুলো যেন রূপকথার কুটির!
চারপাশে পাথরের দেয়াল দিয়ে বানানো হয়েছে ঘর। এগুলো গোলাকৃতির, অনেকটা তাঁবুর মতো। ছন বা নাড়া ব্যবহার না করা হলেও রাইয়ের খড় দিয়ে চালা দেওয়া হয়েছে। কেবল শখের বশে এ ধরনের ঘর তৈরি করেন না স্পেনের উত্তর-পশ্চিম কোণের এ বাসিন্দারা। মূলত পার্বত্য এলাকার তীব্র ঠান্ডা থেকে ঘরগুলো তাঁদের সুরক্ষা দেয়। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বলা হয় 'প্যালোজা'। এসব ঘরের কোনোটি আড়াইশ বছরের পুরোনো। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রোমান সভ্যতারও আগে এলাকাটিতে এ ধরনের ঘর নির্মাণের প্রচলন শুরু হয়। খবর বিবিসির
পাথর, কাঠ আর রাইয়ের খড়- এসব দিয়ে তৈরি ঘর শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলায় বেশ কার্যকর। গোলাকৃতির কারণে এতে হিম বাতাস আটকে থাকে না। পাথরের পুরো দেয়াল ও জানালার সংখ্যা অল্প হওয়ায় বাইরের ঠান্ডা সহজেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। ওপরে খড়ের চালাও ঠান্ডা প্রতিরোধী। এ ছাড়া ঘর উষ্ণ রাখতে চুল্লির ব্যবস্থাও রাখা হয় ভেতরে, যা লালাইরা নামে পরিচিত। লালাইরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তীব্র শীতে ঘরে টিকে থাকার গল্প।
এনকারেজের চারটি গ্রামে এখনও এসব ঘর রয়েছে। এই এলাকার প্যালোজায় বেড়ে উঠেছেন বর্তমানে বার্সেলোনার বাসিন্দা জাইমে ফার্নান্দেজ উরিয়া। সরকারি চাকরি করতেন তিনি। সেই প্যালোজাটির মালিক এখন তিনি নিজেই। ফার্নান্দেজ সেখানে যান মাঝেমধ্যে। অনেকটা গুদামঘরের মতো এটি ব্যবহার করা হয়। ঘর উষ্ণ রাখার চুল্লির পাশে বসে ফার্নান্দেজ স্মৃতিচারণ করেন তাঁর তিন প্রজন্মের। তাঁরা এ ঘরে থেকেছেন, বেড়ে উঠেছেন। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এ ঘরে থাকা সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন তাঁর মা।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্যালোজায় থাকার অভিজ্ঞতা ফার্নান্দেজের জন্য বেশ সুখকর। তাঁদের জমি বেশি না থাকলেও অনেক গবাদিপশু ছিল। তিনি যে চুল্লির পাশে ঘুমাতেন, সেটি কয়েক প্রজন্মকে উষ্ণতা দিয়েছে। চুল্লির একপাশে গবাদি পশু রাখার স্থান। তিনি সেই স্থানটির ওপরে কাঠের পাটাতনে ঘুমিয়েছেন ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত। নিচে থাকা গবাদি পশু থেকেও তিনি কিছু উষ্ণতা পেতেন। স্মৃতিকাতর ফার্নান্দেজ বলেন, তাঁরা গরু, শূকর, মুরগি ও ঘোড়া পুষতেন।
এ ধরনের ঘরের প্রচলন ক্রমে কমে যাওয়ার কারণও জানালেন ফার্নান্দেজ। তিনি জানান, পার্বত্য উপত্যকায় রাইয়ের চাষাবাদ কমেছে। এতে প্যালোজার চালার জন্য প্রয়োজনীয় খড়ের সংকট দেখা দেয়। চালা তৈরির এ পদ্ধতিকে স্থানীয়রা 'টেইটাউর' বলেন। এ পদ্ধতিটিও এখন বিলুপ্তপ্রায়। পয়ারনেডো গ্রামের এক প্যালোজার মালিক বলেন, প্রতি বছর এগুলোর ছাদ সংস্কারে ব্যয় হয় ২ থেকে ৩ হাজার ইউরো। অনেক সময় সংস্কারের কাজটি নিজেদেরই করতে হয়।
এই প্যালোজার বাসিন্দারা এক সময় নিজেরা নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই উৎপাদন করতেন। বাইরে থেকে তেমন কিছুই তাঁদের আনার সুযোগ হতো না। ১৯৮০-এর দশকে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ছিল না। রাস্তাগুলোও ছিল সংকীর্ণ। লোকজন পশু দিয়ে টানা গাড়িতে যাতায়াত করত। এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। তারপরও লোকজন পাহাড় ছাড়ছে শহরমুখী হয়ে।
মন্তব্য করুন