রংপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. চিত্রলেখা নাজনীনকে ‘স্যার’ না বলায় অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে। ২৪ মার্চ সমকালে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে স্যার বলার বাধ্যবাধকতা নেই’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, উক্ত শিক্ষক একটি সামাজিক কাজের বিষয়ে কথা বলতে জেলা প্রশাসকের কাছে যান। কথা শেষে বিদায়কালে বলেন, ‘আপা, ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।’ উত্তরে ডিসি বলেন, ‘ওই চেয়ারে কোনো পুরুষ থাকলে তাঁকে আপনি কী বলতেন?’ তখন উমর ফারুক বলেন, ‘তাঁকে ভাই বলতাম।’ তখন ডিসি বলেন, ‘এই চেয়ারকে সম্মান করে স্যার বলে ডাকা উচিত।’ এ ঘটনার প্রতিবাদে ওই শিক্ষক তাঁর শিশুসন্তানকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক নিচে নেমে এসে প্রকাশ্যে উমর ফারুকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।

রাষ্ট্রের মালিক জনগণ– সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এ সত্যটি মাঝেমধ্যে প্রজাতন্ত্রের কোনো কোনো কর্মচারী ভুলে যান। সংবিধান অনুযায়ী আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও নিজেদের পরিচয়ে ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি প্রচলিত থাকায় রাষ্ট্রের মালিকের কাছ থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন শোনাটা অধিকার মনে করেন। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে (সচিবালয়) সাধারণ নাগরিকের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ কম। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের কর্মচারীদের সঙ্গে সেবাগ্রহীতা হিসেবে তাঁদের প্রায়ই যোগাযোগ করতে হয়। ক্যাডার সার্ভিসের সদস্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) থেকে শুরু করে নন ক্যাডারের কর্মচারীদের অনেকেই সেবাগ্রহীতার মুখে ‘স্যার’ সম্বোধনের বাইরে অন্য শব্দ চিন্তাও করতে পারেন না।

বাংলা অভিধান অনুযায়ী স্যারের অর্থ জনাব, মহাশয় বা মহোদয়। চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রবীণ সদস্যকে নবীন সদস্য স্যার ডাকতেই পারেন। কিন্তু অধীনস্থ স্টাফের বাইরে অন্য বিভাগের কর্মী বা একজন নাগরিকের কাছে সরকারি কর্মচারীরা ‘স্যার’ সম্বোধন প্রত্যাশা করেন কীভাবে?

রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনই প্রথম নন। প্রায়ই মাঠ প্রশাসনের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসছে। ২০২১ সালের ৮ জুলাই মানিকগঞ্জের সিংগাইরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লাকে স্যার না বলে আপা ডাকার অভিযোগে পুলিশি নির্যাতন সহ্য করতে হয় এক ব্যবসায়ীকে। এ নিয়ে তখন বহু আলোচনা হয়। আমাদের ধারণা ছিল, ওই ঘটনা থেকে সরকারি মাঠ প্রশাসনের লোকেরা শিক্ষা নেবেন। কিন্তু আমাদের সে আশার গুড়ে বালি দিয়েছেন রংপুরের ডিসি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর আচরণে মনে হয়েছে, তিনি ডিসির চেয়ারকে সিংহাসন ভেবে বসে আছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজা-বাদশাহ যুগের মতো নিজেকে বাদশাহ আর নাগরিককে প্রজা ভাবলে চলবে না।

সমকালে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা কি ভুলে যাচ্ছেন– তাঁদের বেতন-ভাতা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় হয়?’ প্রশ্নটা শুধু তাঁর নয়; সব সচেতন মানুষের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেখানে নাগরিকদের কাছ থেকে আপা শুনতে অভ্যস্ত, সেখানে আমলারা স্যার শোনার আশা কীভাবে করেন?

রাজনীতি ও অপরাধ বিটে আট বছর কাজ করার সুবাদে পুলিশ সদরদপ্তর, র‍্যাব ও ডিএমপির ঊর্ধ্বতনদের অন্য সহকর্মীর মতো আমিও ভাই, আপা, দাদা, দিদি বলেই সম্বোধন করেছি। তাই বলে গ্রামের বাড়ি গিয়ে থানার ওসিকে ভাই বলার দুঃসাহস দেখাইনি। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি, এক সাংবাদিক সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ভাই বলায় উত্তেজিত হয়ে ওই কর্মচারী বলেছেন, ‘ডেকোরাম আছে; আমাকে স্যার বলতে বলছি না। ভাই কেন বললেন?’ বাস্তবতা হলো, এসব কর্মচারী স্যার সম্বোধনের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে চান না। নিজেদের রাজা আর প্রজাতন্ত্রের মালিককে প্রজা মনে করার ভূত তাঁদের মাথা থেকে তাড়াতে হবে।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com