২৩ মার্চ, ১৯৪০ থেকে ২৬ মার্চ, ১৯৭১– এই ৩১ বছর ৩ দিনে কীভাবে পাল্টে গেল আমাদের জগৎ! তবে উপক্রমণিকারও আছে প্রাক-কথা, আর ইতিহাসের বহমান ধারার তো নেই কোনো উপসংহার। ১৯৪০ সালে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রস্তাবিত বিভক্ত ভারতের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। প্রস্তাবে ছিল ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাংশে মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে, আর ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল অন্যবিধ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বাধীন ও সার্বভৌম থাকবে। এর আগে অবশ্য কেমব্রিজে অধ্যয়নরত একজন ছাত্র– চৌধুরী রহমত আলি মুসলিমপ্রধান পশ্চিম ও পূর্বের ওই দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নামকরণ করেছিলেন যথাক্রমে পাকিস্তান ও বাংলাস্তান। কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালও দ্বিজাতিভিত্তিক ব্রিটিশমুক্ত ভারতবর্ষের কথা ভেবেছিলেন। অবশ্য খণ্ডিত স্বাধীন ভারতবর্ষের কথা দানা বাঁধতে শুরু করল, যখন দেখা যাচ্ছিল অখণ্ড স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের স্বার্থরক্ষা সম্ভবপর হবে না। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের সময়ে অবশ্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্ভবপর বলে মনে হচ্ছিল, তবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পর ক্রমেই ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বাস্তবতা প্রকট হচ্ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় নেতা চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারীও বিভক্ত ভারতের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ভাষাভিত্তিক কোনো জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখা যায়নি। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আই-এন-এ জাপানিদের সহযোগিতায় ভারত স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হলো, তবে ‘জয় হিন্দ’ ছিল তাঁর স্লোগান। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এই আন্দোলন একটিই অবিভক্ত স্বাধীন ভারতের পরিকল্পনা করেছিল– হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত হিন্দুস্তানি ছিল তাঁর ঘোষিত একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তবে লিখিত হবে দুই স্ক্রিপ্টে– ফার্সি ও দেবনাগরী। ‘যাঁহা হামারা মন্দির-মসজিদ শিখোকা গুরুদ্বারা হ্যায়, দূর হটো ভাই দুনিয়াওয়ালে হিন্দুস্তান হামারা হ্যায়’– এই ছিল তাদের ‘তারানা’।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-অন্তে সেই স্বপ্ন হলো ধূলিসাৎ। আর ত্বরিতগতিতে ব্রিটিশরা পাততাড়ি গুটিয়ে ভারত থেকে চলে যেতে চাইল। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ তীব্র সহিংস রূপ নিল। কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান না করেই সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয়-গভর্নর জেনারেল অপরিণামদর্শী লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩ জুন ১৯৪৭ সালে দ্বিধাবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন– মাত্র দশ-এগারো সপ্তাহের মধ্যেই ১৫ আগস্ট হবে পাকিস্তান ও ভারতভিত্তিক স্বাধীনতা, বহু জটিল সমস্যা, যেমন– কাশ্মীর, হায়দরাবাদ, জুনাগড়, দেশীয় রাজ্যসমূহ ইত্যাদি অমীমাংসিত রয়ে গেল যেন পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশে সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করার উপাদান হিসেবে। স্যার সিরিল রেডক্লিফ নামের একজন ব্রিটিশ আইনবিদ, ভারত সম্পর্কে যাঁর ধারণা ছিল অতীব সীমিত, দায়িত্ব পেলেন পাকিস্তান-ভারতের সীমা নির্ধারণের। ঘোষণা হলো– পাঞ্জাব ও বাংলার মুসলিমপ্রধান জেলাগুলো থাকবে পাকিস্তানে; উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং আসামের সিলেটে হবে গণভোট। গণভোটে যদি পাকিস্তানপন্থিরা সিলেটে বিজয়ী হয়, তাহলে সিলেট এবং এর সীমান্ত-সন্নিহিত মুসলিমপ্রধান অঞ্চল, অর্থাৎ হাইলাকান্দি ও শিলচর এবং গোয়ালপাড়ার একাংশ পাকিস্তানে সংযোজিত হবে।

৮ জুলাই ১৯৪৭ সালে হলো সিলেটে গণভোট। প্রচারণার জন্য শুধু আসামের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ নন, বাংলা (এবং  বিহার) থেকেও অনেক নেতাকর্মী গেলেন সিলেটে প্রচারকার্য চালাতে। বাংলা থেকে যাঁরা পাকিস্তানভুক্তির পক্ষের প্রচারকার্য চালাতে গিয়েছিলেন, সেখানে তরুণ নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পরবর্তীকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দাঙ্গাবিধ্বস্ত বিহারে মাসাধিককাল রিলিফ কার্যক্রম করে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশে চলে এলেন সিলেট। বহুবিধ অসুবিধা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গণভোটে পাকিস্তানপন্থিদের নিরঙ্কুশ বিজয় হলো। কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সিলেট (এবং তৎসন্নিহিত মুসলিমপ্রধান এলাকা) পাকিস্তান-সংযুক্তির বদলে সিলেট জেলাকেই ভাগ করে করিমগঞ্জ মহকুমার অধিকাংশ এলাকাকে পাকিস্তান থেকে বাদ দেওয়া হলো। এর ফলেই সেসব এলাকা আজ বাংলাদেশে নেই, ভারতের আসামের অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। সন্দেহাতীতভাবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও স্যার সিরিল রেডক্লিফের বহু সিদ্ধান্তই নীতিবিরুদ্ধ, অন্যায়, পক্ষপাতদুষ্ট এবং পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী (এবং ফলাফল অনুক্রমে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের) হয়েছিল। যা হোক, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল পাকিস্তানে বাংলাভাষীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৪৮ সালে প্রথমে সিলেটেই ‘মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ এবং ‘নও-বেলাল’ পত্রিকায় দাবি ওঠানো হলো– শুধু উর্দু নয়, উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। তার পরের কাহিনি সুবিদিত। ঢাকায় গঠিত হলো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এগিয়ে এলেন অন্যদের সঙ্গে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেক্রেটারিয়েট গেট থেকে গ্রেপ্তার হন। বস্তুত এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হলো, যা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং পাকিস্তানের সংবিধানে তা সংযোজিত হওয়ার পরেও বাংলা ও বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মূলমন্ত্র হিসেবে পল্লবিত হলো। ’৪৮ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অবিসংবদিতভাবেই ক্রমে ক্রমে একক নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মনে পড়ে ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি থাকাকালীন কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণ, ‘বিপ্লবী’ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (যেখানে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর অমর গান ‘আমার ভাইয়ের...’ প্রথম গীত হয়েছিল)-এর আয়োজন ইত্যাদি কারণে গাফ্ফারসহ আমরা চারজন কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম এবং তখন বহিষ্কৃতি আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে জোর ছাত্র আন্দোলনের সময়ে আমরা তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তাঁর অনুপ্রেরণাদায়ী নির্দেশেই আন্দোলনকে বৃহদাকার ও শক্তিশালী করি এবং তাতেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ বাঙালির আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে বস্তুতপক্ষে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির অস্তিত্ব ও সংগ্রামের দৃপ্ত শপথই ঘোষণা করে। তা ছিল উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার আহ্বান। পাকিস্তানভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিবর্তে বা অবসানে এটিই কি ত্রিজাতিতত্ত্ব বা বহুজাতিতত্ত্বের উন্মেষের আবাহন? এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে বহু উত্তান-পতনের কালস্রোতে আজ সেই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একটি দার্শনিক ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে এক উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে। এটা আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সর্বজনস্বীকৃত যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু জাতির পিতাই নন; তিনি স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার স্রষ্টা। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকামী ও বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামী মানুষের এক মহানায়ক।