আগেও নিজস্ব জমি ছিল না রোজি বিশ্বাসের পূর্বপুরুষদের। এখনও নেই। এখানে-ওখানে সড়কের ধারে ঘর তুলে বসবাস করতেন তাঁরা। যাযাবর জীবনের সমাপ্তি হয়েছে চার পুরুষ আগে। বর্তমানে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকোলা খ্রিষ্টানপাড়ায় থাকেন তাঁরা। গির্জার জমিতে আশ্রয় মিলেছে রোজির পরিবারের মতো আরও ১৫টি পরিবারের।

অন্য বাসিন্দা মুক্তি প্যারোরা বললেন, গির্জার মোট জমির পরিমাণ ১ বিঘা ৮ কাঠা। এর মধ্যে গির্জা-কবরস্থান বাদে বাকি জায়গায় বসবাস তাঁদের। ছোট ছোট ঘর তুলে বস্তির মতো গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এতে কষ্ট হয়, তবে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবনায়ও আনেন না তাঁরা। মুক্তির মতে, গির্জা ছেড়ে চলে গেলে মহাপাপ হবে, যা করতে চান না।

পাড়াপ্রধান প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, 'আমরা সবাই খুব অভাবী। তবু এই পরিবারগুলোর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অনেক মজবুত। ঝগড়া-বিবাদ লাগে না বললেই চলে।'

এখানে বসতি গড়া ১৫ পরিবারের সবাই মাল পাহাড়িয়া জাতির। ফাবিয়ান বিশ্বাস নামে একজন বলেন, 'পূর্বপুরুষদের মুখ থেকে শুনেছি, আগে ছিন্নমূল হিসেবে বসবাস করতেন তাঁরা। পরে কয়েকটি পরিবারকে বসবাসের অনুমতি দেয় গির্জা কর্তৃপক্ষ।' ধীরে ধীরে অন্য পরিবারগুলোও আসে।

উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের ৯ গ্রামে ১৩টি জাতির দেড় সহস্রাধিক মানুষের বাস। এ ছাড়া উপজেলার অন্যান্য স্থানে থাকেন আরও দেড় হাজারের মতো। এর মধ্যে মুণ্ডারি, পাহাড়ি, মাল পাহাড়িয়া, চুনকার, বাদ্যকার, সর্দার, বাগদি, লোহারা, মুসিরি, মাহাতো জাতি উল্লেখযোগ্য।

পতিরাজপুর গ্রামের আদিবাসী পল্লিতে ৭০ পরিবারের জনসংখ্যা ৪ শতাধিক। তাদের বেশিরভাগই বাগদি। কৃষিকাজ ও কুঁচিয়া ধরাই তাদের জীবিকা। কেউ কেউ অবশ্য তীর-ধনুক ও জাল দিয়ে খরগোশ শিকার করে। কেউ আবার কোচ দিয়ে কচ্ছপ ধরে। পাশাপাশি একালি (বল্লম ধরনের অস্ত্র), বাঁশপাতার তীরসহ নানা অস্ত্র ব্যবহার করেন।

তবে এখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এরপরও নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে আশপাশের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে অনেকেই। তবে বেশিরভাগই প্রাথমিকের পর ঝরে যায় বলে জানান সত্য সরদার রায় ও সন্তোষ রায় নামে দুই ব্যক্তি।

স্থানীয় শ্রমিক শারতি রানী রায় বলেন, 'বছরের অর্ধেক সময় কাজ থাকে। বাকি সময় বেকার থাকতে হয়। মজুরিতেও আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়। এখনও দিনে মাত্র ৩০০ টাকা মজুরিতে কাজ করতে হয়।'

প্রবীণ বাসিন্দা সাধন রায় বলেন, 'আমরা কেউ বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারের কোনো ধরনের ভাতা পাই না।'

দাশুরিয়া ইউনিয়নের মাড়মি আদিবাসী পল্লিতে ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেন্ট ফিলিপস শিশু শিক্ষাকেন্দ্র। একসময় এটি পরিচালনা করত খ্রিষ্টান মিশন। পরে এর দায়িত্ব নেয় বেসরকারি সংস্থা কারিতাস। এতে ২ শতাধিক শিশু পড়াশোনা করত। অর্থাভাবে ৪ বছর ধরে এর কার্যক্রম বন্ধ।

এখানের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই মাল পাহাড়িয়া। প্রবীণ বাসিন্দা পৌল বিশ্বাস বলেন, গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৪০০। তাদের জন্য চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। জরুরি প্রয়োজনে প্রসূতিদেরও নিতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূরে।

২ শতাধিক বছর আগে ভারতের নানা স্থান থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের ওই এলাকায় নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে নীলচাষ করানো হতো। সেই সঙ্গে হিংস্র বন্যপ্রাণী শিকার করতেন তাঁরা। পৌল বিশ্বাস বলেন, ওই সময় ঘন বন-জঙ্গল কেটে সাফ করেন তাঁরা। তৈরি করেন বিশাল এক দিঘিও। কাঠ কেটে, পশু শিকার করে ও মাছ শিকার করে জীবন ধারণ করতেন পূর্বপুরুষরা। বর্তমানে সেই দিঘিও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

সারাবছর অপরের জমিতে কাজ করতে হয় এখানকার বেশিরভাগ মানুষকে। মাছ বা পশু শিকারের জায়গা নেই, দিঘিও বেহাত। সরকারি ভাতাও মেলে না তাঁদের। একই অবস্থা অন্যান্য গ্রামের আদিবাসীদেরও। আটঘরিয়া কলকলিপাড়ার স্টেশনপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকে ৬০ পরিবার মুণ্ডারি, ১৫ পরিবার মাল পাহাড়িয়া এবং চুনকার ও বাদ্যকারদের ৫টি পরিবার। ফরিদপুর গ্রামে বসতি আছে বাগদি ও শৈলেন জাতির ৬০ পরিবার, নিকোড়হাটা সুগার মিলের ১০ নম্বর কলোনিতে ২০ পরিবার পাহাড়ি, ১০ পরিবার লোহারা ও ৮ পরিবার বাগদি বসবাস করে। চক শ্রীরামপুর গ্রামে পাহাড়ি, মাল পাহাড়িয়া, লোহারা ও মুসিরি জাতির ৫৫ পরিবারের বসত। লক্ষ্মীকোলা গ্রামে ২০ পরিবার মাল পাহাড়িয়া, গোয়ালবাথানে ২৫ পরিবার মুণ্ডারি, ফতেপুর গ্রামে ২৫ পরিবার বাগদি এবং রামচন্দ্র বহরপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাহাতো বা ভূঁইমালি ও বাগদি জাতির ১৫ পরিবার বসবাস করে। তাদের বেশিরভাগের দিন কাটে খেয়ে-না খেয়ে, মানবেতরভাবে।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ঈশ্বরদী উপজেলা শাখার সভাপতি সুশান্ত মুণ্ডারি বলেন, 'আমাদের ৪২টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ৩টি পরিবারের জমি আছে। বাকি সবাই ভূমিহীন।'

মুলাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক মালিথা বলেন, যাঁরা এখনও ভাতার আওতায় আসেননি, পরবর্তী ধাপে অনলাইনের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হবেন। এর প্রক্রিয়া চলছে।

দাশুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান বকুল সরদার বলেন, আইনি জটিলতায় আদিবাসীদের বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়া সম্ভব হয়নি।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, 'ভাতা পাওয়ার উপযোগী আদিবাসীদের আইডি কার্ড যাচাই করে ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।'

ইউএনও পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, ঈশ্বরদীর বিভিন্ন আদিবাসী পল্লিতে ইতোমধ্যে ৮টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক ধাপে প্রায় ৫০ ছাত্রীকে বাইসাইকেল ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।