- সম্পর্ক
- প্রবল বন্যায় এক মায়ের বিরল ভালোবাসার গল্প
প্রবল বন্যায় এক মায়ের বিরল ভালোবাসার গল্প

নানির গলা জড়িয়ে কাঁদছেন রমজানা। তিনি কীভাবে ভুলবেন তাঁকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে গিয়েই মারা গেছেন ভাই আর মা, যাঁদের লাশ পাওয়া গেছে চার দিন পর। জৈন্তাপুরের মানিকপাড়খোলার আমিরাবাদ এলাকা থেকে মঙ্গলবার তোলা -মাহবুব হোসেন নবীন
বাড়ির উঠানে কদমগাছ। গাছের নিচেই কাদামাটিতে বুক চাপরাচ্ছিলেন আশি পেরোনো জয়তারা আর নাতনি রমজানা। তাঁদের শোকে সমব্যথী হয়ে বাড়িজুড়ে কান্নার সুর। শতাধিক বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ জয়তারা-রমজানাকে ঘিরে করে যাচ্ছেন বিলাপ। কেউ তাঁদের প্রতিবেশী, কেউ এসেছেন গ্রামের নানা প্রান্ত থেকে। সিলেটের জৈন্তাপুরের মানিকপাড়খোলা ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের এমন ছবি গতকালের। বন্যায় শত শত মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মঙ্গলবার সবাই কেঁদেছেন জয়তারা আর রমজানার জন্য। কিছু সময়ের জন্য গ্রামের অন্যরা তাঁদের দুঃখ-বেদনা ভুলে এই পরিবারের জন্য চোখ ভিজিয়েছেন।
সকাল ১১টার দিকে ভয়াবহ দুঃসংবাদটি হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। প্রথমে খবর আসে- বাছাইরখাল এলাকায় এক নারীর প্রায় অর্ধগলিত লাশ পড়ে আছে ক্ষেতে। লোকজন খুব বেশি সময় নেননি লাশ চিনতে। মরদেহটি রমজানার মা নজমুন বেগমের (৬০)। এর মিনিট দশেক পরই আরও বড় দুঃসংবাদ। মায়ের লাশের কাছেই এক জেলের জালে উঠে আসে আরেক কিশোরের মরদেহ। জানা যায়, সেটি নজমুনের একমাত্র ছেলে সৈয়দ রহমানের।
মা আর ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে ছুটে আসেন রমজানা। বাবার বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরত্বে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। হতদরিদ্র রমজানার বাবা ও শ্বশুরবাড়ির অভাব-অনটনের গল্পটা বড় করুণ। স্বাভাবিক সময়েও একবেলা খান তো আরেক বেলা আধাপেটা থাকেন তাঁরা। বছর ছয়েক আগে রমজানার বাবা আজব আলী মারা যান। পাথর কুড়ানোর কাজ করতেন তিনি। মাথার ওপর পাথর পড়েই মারা গেছেন আজব। রমজানার স্বামীও তেমন কোনো কাজ করেন না। তাঁদের সংসারে দুই সন্তান। ফাতেমার বয়স দুই বছর ও মোস্তফার চার মাস।
রমজানা জানান, শনিবার যখন বন্যা পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ, তখন ভাই রহমানকে নিয়ে তাঁর মা নজমুন ছুটে আসেন তাঁদের (রমজানার) বাড়িতে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। মা ও ভাইয়ের পুরো শরীর ভেজা এবং দুরবস্থা দেখে রমজানা তাঁদের কাছে জানতে চান- কেন বন্যার মধ্যে তাঁরা এসেছেন। তখন রমজানার মায়ের উত্তর ছিল- বাড়ি এখনও পুরোপুরি ডোবেনি। জামাই-নাতি-নাতনিদের নিয়ে যেতে এসেছি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও আর্থিক দৈন্যের কারণে রমজানা বা তাঁর মায়ের মোবাইল ফোন কেনার সাধ্য ছিল না। ফোন থাকলে তাতেই বা কী লাভ হতো! দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে পরস্পর যোগাযোগের জন্য নেটওয়ার্ক পেতেন না। তবে একজন মা সাঁতার না জেনেও নিজ বাড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে গলাসমান পানি ঠেলতে ঠেলতে মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বন্যার মধ্যে খোঁজখবর নিলেন এবং সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। আরও পানি বাড়লে যাবে জানিয়ে মাকে বিদায় দেন রমজানা। শনিবার বিকেল ৫টার সময় ছেলেকে নিয়ে যখন নজমুন মেয়ের বাসা থেকে বিদায় নেন, তখন শেষ কথা ছিল- 'বিপদ দেখলে আমার বাড়ির দিকে চলে আইয়ো।' মেয়ে কথাও দিয়েছিলেন- শ্বশুরবাড়িতে সমস্যা হলে বাপের বাড়ির দিকে রওনা হবেন। মোবাইল ফোন না থাকায় রমজানারও জানা হয়নি, গেল চার দিনে মা আর ভাই বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেননি। সবার অগোচরে জীবন দেওয়ার আগে গ্রামের এক সংগ্রামী নারী তাঁর মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ ভালোবাসার নিদর্শনটা রেখে গেলেন। কাদামাটির উঠানের পাশাপাশি দুটি খাটিয়ায় দু'জনের লাশ। গ্রামের লোকজন গোসল করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মেয়ে ও নাতির মৃত্যুসংবাদ শুনে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরের আরেক গ্রাম থেকে ছুটে আসেন জয়তারা। এই শোক কী করে ভুলবেন অশীতিপর বৃদ্ধ। কারণ, নজমুনের ছোট্ট ঘরটিতে যে আর বসবাসের কেউ রইল না।
স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহারুল আলম বলেন, ধারণা করছি, মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে স্রোতের টানে ভেসে যান মা ও ছেলে। চার দিন পর লাশ পেয়ে পুরো গ্রামে বইছে মাতম।
মন্তব্য করুন