ঢাকা রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

জন্মদিন

ভাওয়াইয়ার পাখি আব্বাসউদ্দিন

ভাওয়াইয়ার পাখি আব্বাসউদ্দিন

আব্বাসউদ্দিন আহমদ

বশির আহমেদ

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:৫০ | আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:৫০

আব্বাসউদ্দিন আহমদ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রথম শিল্পী যিনি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন তার মধুর কণ্ঠের সম্মোহনী সুধা দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ২৭ অক্টোবর জন্মেছিলেন আব্বাসউদ্দিন। আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে ভাওয়াইয়ার সুরে তোরষা হাজির হয়েছিল উথালপাতাল রূপে। মূলত তোরষা নদীর তীর ধরে গেয়ে চলা মইষালের গাওয়া সুরই শৈশবে আব্বাসউদ্দিনকে গায়ক করে তুলেছিল। তিনি গানের শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির সহজ-সরল সুর-পাঠ থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন, তাঁর মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি।

কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আব্বাসউদ্দিন আহমদের পরিচিতি দেশজোড়া। আধুনিক গান, স্বদেশি গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান তিনি গেয়েছেন। তবে ভাওয়াইয়ায় তার মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। গানে তার ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। অবশ্য অল্প কিছুদিন ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছিলেন। 

রংপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গেয়ে আব্বাসউদ্দিন প্রথম সুনাম অর্জন করেন। পরে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি গেয়ে জনপ্রিয় হন। তিনি তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লীগানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা আজও অদ্বিতীয়।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহম্মদের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। এই সম্পর্কের সূত্র থেকেই নির্মাণ হয়েছে বিখ্যাত কিছু গান। শিল্পীর অনুরোধে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেন ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। আজও হারায়নি এ গানের আবেদন।

আব্বাসউদ্দিনের শিক্ষাই ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া যা শিখিয়ে দিয়েছে, সেটাই তার শিক্ষা। বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়, ‘এক হয়ে যাওয়া’, এটাই লোক সংস্কৃতির মূল শিক্ষা। মানব প্রজন্ম সামনের দিকে যখন এগিয়ে যায়, তখন এক হতে চায়। ভাওয়াইয়ায় যে আদিম ধর্ম বিশ্বাস ও লোকাচারের স্থান তাতে প্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসের স্থান আছে, আছে নদী, বন, পাথর, বৃক্ষ বন্দনা। রাজবংশী মেয়েদের বাঘ-কুমারী পূজা, আছে তিস্তা, তোরষা, সঙ্কোশ নদীকে দেবতা রূপে পূজা।

শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ ছিলেন সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী। কিন্তু কোনো মহৎ শিল্পীর পক্ষে কেবলমাত্র সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী হওয়াই বড় কথা নয়, তার গানে নিজস্ব ব্যক্তিত্বটি যতক্ষণ ফুটে না ওঠে ততক্ষণ সে শিল্পীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় না। আব্বাসউদ্দিনের একটি বিশেষ ভঙ্গি ছিল গায়ক হিসেবে, যা তার একান্ত নিজস্ব। যখন তিনি পল্লীর গান গেয়েছেন তখন তার স্বরে পল্লীর মায়া জড়ান থাকত, আবার যখন তিনি আল্লাহর রাসূলের উদ্দেশে গান করেছেন তখন একান্ত বিশ্বাসী, ভক্ত হৃদয়ের নিবেদিত চিত্ততার, ধ্যানী পুরুষের মরমী মনের স্পর্শ তাতে ফুটে উঠত, তিনি যখন উদ্দীপনামূলক কওমী গান গাইতেন তখন সে গানে এক পুরুষসিংহের বলিষ্ঠ আবেগ দৃপ্ত হয়ে উঠত। তার গাইবার উদাত্ত ভঙ্গি, প্রত্যেকটি কথার স্পষ্ট উচ্চারণ, গভীর দরদ ও অনুভূতিশীল হৃদয়ে উষ্ণ স্পর্শ তার গানকে শ্রোতার মরমে সহজে পৌঁছে দিতে পারত।

আব্বাসউদ্দিনের একটি বিখ্যাত ভাওয়াইয়া- ‘ওকি একবার আসিয়্যা সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়্যারে/ওদিয়্যা ওদিয়্যা যানরে বন্ধু ডারায় না হন পার/ওকি ওরে’... এই গানটির ‘ওরে’ শব্দটি তিনি যত দরদমাখা কণ্ঠে হাজির করেছেন সেরকম করে আজও ভাওয়াইয়া অঙ্গনে কোন শিল্পী উপস্থাপন করতে পারেননি। এটি অনন্য হয়ে আছে শুধু তারই কণ্ঠে।

বাংলার লোকগানের ধ্রুপদী সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব মহান এই প্রবাদপুরুষ শিল্পীর আজ ১২৩ তম জন্মদিন। ভাওয়াইয়া দর্শক-শ্রোতা, শিল্পী, অনুরাগী সবাই তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।

আরও পড়ুন

×