দুই বছর আগে ঈদুল ফিতরের আগের রাতে পাশের বাসায় যাওয়ার পর থেকে 'নিখোঁজ' ছিল আট বছরের সাফওয়ান আল নিনাদ। ঈদের দিন বাসার অদূরে একটি বেকারির ভ্যানের ভেতর মিলেছিল তার লাশ। খুশির ঈদে তার জন্য কেনা নতুন পোশাক জড়িয়ে ছিল স্বজনদের আর্তনাদ। দুই বছর জানা যায়নি কীভাবে খুন হয়েছিল নিনাদ। অবশেষে জট খুলেছে। এক কিশোরীর বর্ণনার পর ধরা পড়েছে মূল হোতা। জানা গেছে খুনের কারণ ও বিবরণ।
রাজধানীর বনশ্রীর মেরাদিয়া এলাকার ভুইয়াপাড়ার এক বাসায় এমনই বিষাদময় ঈদ এসেছিল ২০১৮ সালের জুনে। নিনাদের লাশ পাওয়ার পর অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন স্বজনরা। থানা পুলিশ, ডিবি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই জট খুলতে পারেনি। মামলা যায় সিআইডির কাছে।
সিআইডির পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মঈনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ দুই বছর পর ১৪ বছরের এক কিশোরীর জবানবন্দিতে নিনাদ হত্যারহস্যের জট খুলেছে। গতকাল বুধবার এ মামলায় মূল হোতা খাদিজা আক্তার রানীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিনাদের মায়ের মামি তিনি।
রানী ছিলেন নিনাদদের প্রতিবেশী। জমিজমা নিয়ে নিনাদের বাবা স্বপন বেপারীর সঙ্গে বিরোধের জেরে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে জানান সিআইডির পরিদর্শক।
মঈনুল ইসলাম জানান, রানীর বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছে ১৪ বছরের বীথি আক্তার ও তার পরিবার। ঈদের আগের রাতে সে রানীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। ওই সময় নিনাদকে নিয়ে বাসায় ঢোকেন রানী। চকলেট দেওয়ার কথা বলে রানী কৌশলে নিনাদকে তার বাসায় ডেকে আনেন। বীথি তা দেখেছে।
বীথি এরই মধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়েছে বলে জানান তিনি। বীথি সমকালকে বলে, ঈদের আগের রাতে রানী কাকির বাসায় গেছিলাম। তার মেয়ে জান্নাতের সঙ্গে বসা ছিলাম। এ সময় নিনাদকে নিয়ে কাকিকে বাসায় আসতে দেখছি। কিছুক্ষণ পর ১০০ টাকা দিয়ে আমাকে ও জান্নাতকে বেলুন কিনতে বাইরে পাঠান। বেলুন কিনে বাসায় ফেরার পর নিনাদ কোথায় জানতে চাইলে কাকি বলেন, তার বাসায় ফিরে গেছে। এরপর আঙ্কেলকে (রানীর স্বামী) কোল বালিশের মতো কিছু একটা নিয়ে নামতে দেখি। এগুলো কী জান্নাত, এটা জানতে চাইলে কাকি জবাব দেন পুরোনো কাপড়। পরদিনই শুনি নিনাদের নাকি লাশ পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মঈনুল ইসলাম জানান, কিশোরী বীথি জবানবন্দিতে বলেছে, নিনাদকে রানীর সঙ্গে দেখার পর সে প্রশ্ন করে, পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া থাকলেও কেন নিনাদকে বাসায় এনেছে? জবাবে রানী জানান, চকলেটসহ ওকে নানা কিছু কিনে দেওয়া হবে। এরপরই বীথি ও জান্নাতকে বাইরে পাঠিয়ে নিনাদকে নিয়ে ছাদে যান রানী ও তার স্বামী জহিরুল ইসলাম লুড্ডু। তার আগে স্থানীয় দোকানি সাদেকের কাছ থেকে পলিথিন কিনে আনেন লুড্ডু। ছাদে নিয়ে নিনাদকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ছোট্ট শিশুর নিথর দেহ পলিথিনে মুড়িয়ে কোল বালিশের মধ্যে ঢোকানো হয়। কোল বালিশের মতো করে মৃতদেহটি নিয়ে বাসা থেকে প্রায় পাঁচশ গজ দূরে একটি খোলা মাঠে ভ্যানের ভেতরে রাখা হয়।
প্রায় আড়াই শতাংশ জায়গা নিয়ে নিনাদের নানা-নানির সঙ্গে মামলা চলছিল রানীর পরিবারের। নানির বাসায় নিনাদের বাবা ঘর-জামাই হিসেবে বসবাস করেন। নিনাদের নানা-নানির সঙ্গে রানীর বিরোধের জেরে প্রায়ই ঝগড়া হতো।
সিআইডি বলছে, এখন পর্যন্ত চারজন এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কিশোরী বীথি ছাড়াও দোকানি সাদেকুর রয়েছেন। তার দোকান থেকে লুড্ডু পলিথিন কিনেছিলেন।
বীথি যা দেখেছিল তা আরেক ভাড়াটিয়া মাকসুদা বেগমকে বলেছিল। তিনিও সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
বনশ্রী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র ছিল নিনাদ। তার বাবা স্বপন বেপারী বলেন, ঈদের দিন দুপুরে ছোট বাচ্চারা বন্দুক নিয়ে খেলা করছিল। খেলনা বন্দুকের গুলি হঠাৎ ভ্যানের ভেতর পড়ে। বাচ্চারা দেখে ভ্যানের ভেতর কিছু একটা ঝুলে রয়েছে। এরপর শিশুরা চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে গিয়ে বালিশে মোড়ানো লাশ উদ্ধার করে। আমাদের পরিবারকে মানসিকভাবে 'দুর্বল' করতে নিনাদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সে ছিল পরিবারের সবার 'নয়নের মণি'।
দোকানি সাদেক বলেন, 'লুড্ডু দোকানে এসে বলে আমাকে একটা চিপসের পলিথিন দাও। আমি মনে করেছি ময়লা ফালানের জন্য চাইছে, আমি দিছি। কারও লাশ গুম করতে পলিথিন চেয়েছে, এটা কল্পনায়ও ছিল না।'
প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও হত্যার ক্লু বের করতে পারেনি। পরে মামলার তদন্তভার যায় গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। তাদের চার্জশিটে নারাজি দেন স্বপন। এরপর তদন্ত শুরু করে পিবিআই। তাদের চার্জশিটেও নারাজি দেওয়া হয়। এরপর তদন্ত শুরু করে সিআইডি।

বিষয় : মেরাদিয়ায় নিনাদ হত্যা

মন্তব্য করুন