- সাহিত্য ও সংস্কৃতি
- সৃজন-প্রেরণার উজ্জ্বল সন্ধ্যা
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ ও ২০২০
সৃজন-প্রেরণার উজ্জ্বল সন্ধ্যা
![ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানে [বাঁ থেকে] পুরস্কারজয়ী রঞ্জনা বিশ্বাস, টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের এমডি এ. কে. আজাদ, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও সিইও সেলিম আর. এফ. হোসেন, প্রধান অতিথি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ, আফসান চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, মোজাফ্ফর হোসেন, কবি মোহাম্মদ রফিক ও সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন](https://samakal.com/uploads/2022/01/online/photos/Untitled-46-samakal-61f2e1bb1ab7f.jpg)
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানে [বাঁ থেকে] পুরস্কারজয়ী রঞ্জনা বিশ্বাস, টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের এমডি এ. কে. আজাদ, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও সিইও সেলিম আর. এফ. হোসেন, প্রধান অতিথি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ, আফসান চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, মোজাফ্ফর হোসেন, কবি মোহাম্মদ রফিক ও সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন
দশক পেরিয়ে 'ব্র্যাংক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার' পরিণত হয়েছে দেশের সাহিত্যজগতের অন্যতম প্রেরণার নাম। এবার একযোগে বসেছিল বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের আরাধ্য এ পুরস্কারের নবম ও দশম আসরের আয়োজন। গত ২১ জানুয়ারি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে পুরস্কৃত করা হয় ২০১৯ ও ২০২০-এর বিজয়ী ছয় সাহিত্যিককে। জমকালো এই আয়োজনের আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন সঞ্জয় ঘোষ
সাহিত্যিকরা পুরস্কার বা প্রতিযোগিতার জন্য সাহিত্যরচনা করেন না- এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, পুরস্কার সাহিত্যিকদের কাজের প্রতি পাঠক ও সমাজের এক প্রকার স্বীকৃতির মতো কাজ করে। সাহিত্যিককে তার কাজের দিকে আরও জোরালোভাবে, অধিকতর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধাবিত হবার পেছনে শক্তি জোগায়। সেই সঙ্গে সাহিত্যিককে এবং তার কাজকে বর্ধিত আওতায় পরিচিত করাতে ভূমিকা রাখে সাহিত্য পুরস্কার। আর সে লক্ষ্যেই বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করতে ২০১১ সালে সমকালের উদ্যোগে এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের আর্থিক সমর্থনে প্রবর্তিত হয় 'ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার'। যা আজ তার দশটি সফল আয়োজন পেরিয়ে প্রেরণার অনন্য এক অবস্থানে অধিষ্ঠিত। দশকব্যাপী বিস্তৃত সেই প্রেরণাসঞ্চারের ঐতিহ্য বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
দেশের মৌলিক সাহিত্যকর্মকে স্বীকৃতি দিতে সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের প্রেরণায় একদিন যে সাহিত্য পুরস্কারের আয়োজনটি আলোর মুখ দেখেছিল; দশ বছর পেরিয়ে আজ তা দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।
সাহিত্যচর্চার তিনটি বিভাগে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। বিভাগ তিনটি হচ্ছে :এক- 'কবিতা ও কথাসাহিত্য', দুই- 'প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ' এবং তিন- 'হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার'। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বরেণ্য এ লেখকের নামে ২০১৩ সালে তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কারটির নাম রাখা হয়। অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী সাহিত্যিকরা এ ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন। এ বয়সসীমার লেখকদের যে কোনো প্রকার সাহিত্যকর্মকেই এ পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়। প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ নিয়ে মননশীল শাখা এবং কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে সৃজনশীল শাখা। এ দুই শাখাতে বিজয়ী লেখকরা প্রত্যেকে পেয়েছেন দুই লাখ টাকা অর্থমূল্যের চেক। হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক শাখায় বিজয়ীকে প্রদান করা হয়েছে এক লাখ টাকার চেক। সেই সঙ্গে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে প্রদান করা হয় পদক এবং সম্মাননাপত্র।
২০১১ সালে প্রবর্তিত এ মহাযজ্ঞের ১০ বছরের বৃত্ত পূরণ হয়েছে আগেই। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া অষ্টমবারের আয়োজনের পর পুরস্কারের নিরবচ্ছিন্নতায় ব্যাঘাত ঘটে। মূলত সমগ্র পৃথিবীই তখন তার নিরবচ্ছিন্নতা ভেঙে অভূতপূর্ব এক মহামারির কবলে পর্যবসিত হয়। করোনাভাইরাসের মৃত্যুথাবায় থেমে যায় যেন সমস্ত জীবনসংসার। বাংলাদেশও তা থেকে দূরে থাকতে পারেনি। সাহিত্য পুরস্কারটির নবম আসরের ঠিক প্রস্তুতিকালে করোনার তীব্র ছোবল তছনছ করে দেয় আমাদের জীবন-বাস্তবতাকে। মহামারির ভয়াবহতা আর সামাজিক দূরত্বের বাস্তবতায় আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এবারও যখন সব আয়োজন শেষ, তখন ফুঁসে উঠেছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। কিন্তু সেই ঢেউয়ের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত শুক্রবার পর্দা উঠেছে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানের। এবারের আসরে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে একসঙ্গে দুই বছরের- ২০১৯ ও ২০২০ সালের।
২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে সমগ্র বছরে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে পুরস্কারের জন্য জমা পড়া আট শতাধিক গ্রন্থ হতে নির্ধারিত তিনটি শাখায় নির্বাচন করা হয়েছে সেরা ছয় লেখককে। দেশের প্রথিতযশা চার সাহিত্যিকের সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের বিবেচনায় তারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রায় তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় পূজা সেনগুপ্তের নৃত্য-ভাবনা ও নির্দেশনায় তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটারের নৃত্য দিয়ে। এরপর এমন দহন দিনে কণ্ঠশিল্পী অদিতি মহসিন গেয়ে ওঠেন কবিগুরুর 'বিপুল তরঙ্গ রে'। এই গানে যেন নতুন উজ্জীবন তৈরি হয় হলরুমজুড়ে। একে একে তিনি গেয়েছেন চারটি গান আর জীবনের আবাহনে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন উপস্থিত অতিথিবৃন্দ।
পুরস্কার আয়োজনের আদ্যোপান্ত দুটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশনস ইকরাম কবীর।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কোলাহলমুখর পুরো হলে নিমেষেই নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। ঘোষণা করা হয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিকদের নাম। জুরি বোর্ডের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে নাম ঘোষণা করতে থাকেন আর তুমুল করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে মিলনায়তন। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার-২০১৯ পেয়েছেন প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ ও কথাশিল্পী মোজাফ্ফর হোসেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার 'দীক্ষাগুরুর তৎপরতা' গ্রন্থের জন্য 'প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ' শাখায় এবং হেলাল হাফিজ তার 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' কাব্যগ্রন্থের জন্য 'কবিতা ও কথাসাহিত্য' শাখায় পুরস্কৃত হন। আর মোজাফ্ফর হোসেন তার 'পাঠে বিশ্নেষণে বিশ্বগল্প :ছোটগল্পের শিল্প ও রূপান্তর' গ্রন্থের জন্য পান 'হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার'।
'দীক্ষাগুরুর তৎপরতা' কথাপ্রকাশ, 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' দিব্যপ্রকাশ এবং 'পাঠে বিশ্নেষণে বিশ্বগল্প :ছোটগল্পের শিল্প ও রূপান্তর' গ্রন্থটি পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার-২০২০ অর্জন করেছেন কবি মোহাম্মদ রফিক, গবেষক আফসান চৌধুরী ও রঞ্জনা বিশ্বাস। কবি মোহাম্মদ রফিক তার 'পথিক পরান' গ্রন্থের জন্য 'কবিতা ও কথাসাহিত্য' শাখায় এবং আফসান চৌধুরী তার '১৯৭১ গণনির্যাতন-গণহত্যা :কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর' গ্রন্থের জন্য 'প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ' শাখায় পুরস্কৃত হন। আর রঞ্জনা বিশ্বাস তার 'বাংলাদেশের লোকধর্ম' গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন 'হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার।'
'পথিক পরান' নাগরী প্রকাশনী, '১৯৭১ গণনির্যাতন-গণহত্যা :কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর' কথাপ্রকাশ এবং 'বাংলাদেশের লোকধর্ম' গ্রন্থটি বেহুলা বাংলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
দুই বছরে পুরস্কারের জন্য তিন শাখায় জমা পড়া বই হতে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন; প্রাবন্ধিক, অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস; অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও কবি আবিদ আনোয়ারের সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ড নির্বাচন করেছে ছয় সেরা বই।
দেশের সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতম সেরা এ পুরস্কার ঘোষণা ও বিতরণ অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলেন দেশসেরা সাহিত্যিক, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সাহিত্যমনস্ক বিজ্ঞজন। গুণীজন ও বিশিষ্টজনের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানস্থল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন। জুরি বোর্ডের সম্মানিত সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এবং অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, একটি জাতির সব মানুষের চাওয়া-পাওয়ার অপূর্ব সম্মিলন সাহিত্য। সাহিত্যিকরাই তৈরি করেন আগামীর মননজগৎ। তিনি ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। ব্র্যাক ব্যাংক এবং সমকালকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সাহিত্যিকরা জাতিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে যাবেন।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সংবাদপত্র সঠিক সংবাদ পরিবেশন করে জনগণের অধিকারবোধ ও ক্ষমতা এবং সমৃদ্ধিকেই তুলে ধরে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানা জনগণের অধিকার- সংবাদপত্র তার বাহন মাত্র। সংবাদমাধ্যম এখন অনেক বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির গুণে মুহূর্তের খবর মানুষ মুহূর্তে পাচ্ছেন এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছেন। সমকাল প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে, তারপর থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে আমরা বিভিন্ন কিছুর সমন্বয় ঘটিয়েছি। এরই একটি প্রতিফল ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, যা শুরু হয়েছে ২০১১ সাল থেকে। আগামীতেও সমকালের এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, যারা এ বছর পুরস্কার পেয়েছেন তারা প্রকৃতই এ পুরস্কারের যোগ্য। সমকাল লেখক-সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করতে পারছে, এটাই আমাদের বড় পাওয়া। গুণীজনকে যে সম্মানিত করতে পেরেছি, সেটিই আমার জন্য বড় আনন্দের এবং গর্বের।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন বলেন, এ পুরস্কারের দশম আসরে ব্র্যাক ব্যাংককে সঙ্গে রাখার জন্য সমকালকে ধন্যবাদ। লেখক-সাহিত্যিকদের বিশেষ করে তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য আমরা এ পুরস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি। এ পুরস্কার বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ একটি স্থান দখল করেছে। আমরা মনে করি, শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা একটি বিনিয়োগ। ব্র্যাক ব্যাংক সেই বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে।
অনুষ্ঠানে উঠে আসে সমকালের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের নাম। যার হাত ধরে এ পুরস্কারের যাত্রা শুরু হয়। বক্তারা গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করেন।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ ও ২০২০ জুরি বোর্ডের পক্ষে বক্তব্যে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল কর্তৃপক্ষ বড় একটি কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। আমি আমার সামান্য জ্ঞান দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি বলে গর্বিত। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার এখন আমাদের দেশের স্বীকৃত উঁচুমানের সাহিত্য পুরস্কার। যারা এ পুরস্কার অর্জন করেন তারা আমাদের কাছে অনুসরণীয় ও বরণীয়।
পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। সাহিত্য মানুষকে মিলিত করে, সমৃদ্ধ করে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতাই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য সাহিত্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। প্রযুক্তির ফলে সভ্যতার যে অগ্রগতি হয়েছে, সেখানে প্রযুক্তি সাহিত্য এবং বইকে সহায়তা দিচ্ছে। প্রযুক্তি যতই অগ্রসর হোক, যতদিন এ পৃথিবীতে মানুষ থাকবে, ততদিন বই থাকবে। কারণ, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বইয়ের মাধ্যমেই ফুটে উঠবে। বই মানুষের সঙ্গী। এই সঙ্গী কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বইয়ের অগ্রযাত্রায় একটি দৃষ্টান্ত।
কবি হেলাল হাফিজ বলেন, বাংলা সাহিত্যের বীর রসের কথা কিন্তু নজরুলের বিদ্রোহীও নয়, আমার নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়ও নয়। শ্রেষ্ঠ বীর রসের কথাটি রবীন্দ্রনাথের- 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।' ১৯৮৬ সালে আমার প্রথম কাব্য 'যে জলে আগুন জ্বলে' গ্রন্থের প্রথম কবিতা ছিল- 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'। এ ভূখণ্ডের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল সেই কবিতা। যে সময়ে 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' লিখেছিলাম, যুদ্ধবিরোধী মানুষ হয়েও তখন সেই কবিতা না লিখে উপায় ছিল না। কবিতা দিয়ে মানুষকে ভালোবাসার পথে আনা যায়। আজ মনে হচ্ছে, তা সার্থক। আমাকে সম্মানিত করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পুরস্কৃত আফসান চৌধুরী বলেন, 'আমাকে পুরস্কৃত করার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের দেশে আমরা স্বল্প কিছু মানুষের ইতিহাস রচনা করেছি, এটি রাজনীতির সীমাবদ্ধতার কারণে। বাংলাদেশ জন্মেছে দুইশ বছরের সংগ্রামের কারণে। সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিল কৃষক সমাজ, এই কৃষক সমাজ বিদ্রোহী কৃষক সমাজ। এ কৃষক সমাজ মুক্ত হয়ে গেছে, তাদের মধ্যবিত্তকে দরকার নেই। এ বয়ানটি বুঝতে হলে দুই হাজার বছরের ইতিহাস বুঝতে হবে। এই সংগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে চলছে। একাত্তর হচ্ছে, যে মুহূর্তে এই সংগ্রাম সফল হয়েছে। এটি কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজের নয়, জনগোষ্ঠীর বটে। ফলে লিখতে হলে সবার ইতিহাস লিখতে হবে।'
কবি মোহাম্মদ রফিক বলেন, 'বাংলা ভাষায় যে যা লিখবে, সেটিই বাংলা সাহিত্য। বিভাজন নয়, আমরা চাই সম্মিলন। আমরা চাই একসঙ্গে সবারই অগ্রগতি হোক। আসুন, একসঙ্গে বাংলা সাহিত্য তৈরি করি।'
তরুণ কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, 'লেখার সময় পুরস্কারের বিষয় মাথায় ছিল না। আমি একেবারে প্রান্তিক জায়গা থেকে এসেছি। আমার বেড়ে ওঠা সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে। এমন পুরস্কারপ্রাপ্তি আমার মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিয়েছে।'
তরুণ লেখক ও গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস বলেন, 'এ পুরস্কারের অংশীদার আমি একা নই। এ পুরস্কারের অংশীদার লোকধর্ম সম্প্রদায়ের সবাই। এ ছাড়া প্রকাশক, আমার স্বজন এবং যারা আমাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। এক সময় আমি একজন গৃহিণী ছিলাম। কিন্তু যখন এ পথে নেমেছি, তখন দেখলাম আমি আর একা দাঁড়িয়ে নেই। আমার কাজে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকালকে ধন্যবাদ জানাই।'
দশ বছর পেরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে বলা যায় 'ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারে' ভূষিত সাহিত্যিকবৃন্দ বাংলাদেশের এবং বাংলা ভাষার সমসাময়িক সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব। তাদেরকে সম্মানিত করার মাধ্যমে মূলত বাংলা সাহিত্যের সৃজনচর্চাকেই সম্মানিত করা হয়েছে। প্রাণিত করা হয়েছে ভবিষ্যতের সাহিত্যসাধনার পথকে। এ পুরস্কারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও তাই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে যে সাহিত্যিকরা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, তাদেরকে নিয়মিত উৎসাহিত ও সম্মানিত করার জন্য এ আয়োজনটি এগিয়ে যাবে বছরের পর বছর।
সাহিত্যিকরা পুরস্কার বা প্রতিযোগিতার জন্য সাহিত্যরচনা করেন না- এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, পুরস্কার সাহিত্যিকদের কাজের প্রতি পাঠক ও সমাজের এক প্রকার স্বীকৃতির মতো কাজ করে। সাহিত্যিককে তার কাজের দিকে আরও জোরালোভাবে, অধিকতর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধাবিত হবার পেছনে শক্তি জোগায়। সেই সঙ্গে সাহিত্যিককে এবং তার কাজকে বর্ধিত আওতায় পরিচিত করাতে ভূমিকা রাখে সাহিত্য পুরস্কার। আর সে লক্ষ্যেই বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করতে ২০১১ সালে সমকালের উদ্যোগে এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের আর্থিক সমর্থনে প্রবর্তিত হয় 'ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার'। যা আজ তার দশটি সফল আয়োজন পেরিয়ে প্রেরণার অনন্য এক অবস্থানে অধিষ্ঠিত। দশকব্যাপী বিস্তৃত সেই প্রেরণাসঞ্চারের ঐতিহ্য বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
দেশের মৌলিক সাহিত্যকর্মকে স্বীকৃতি দিতে সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের প্রেরণায় একদিন যে সাহিত্য পুরস্কারের আয়োজনটি আলোর মুখ দেখেছিল; দশ বছর পেরিয়ে আজ তা দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।
সাহিত্যচর্চার তিনটি বিভাগে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। বিভাগ তিনটি হচ্ছে :এক- 'কবিতা ও কথাসাহিত্য', দুই- 'প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ' এবং তিন- 'হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার'। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বরেণ্য এ লেখকের নামে ২০১৩ সালে তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কারটির নাম রাখা হয়। অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী সাহিত্যিকরা এ ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন। এ বয়সসীমার লেখকদের যে কোনো প্রকার সাহিত্যকর্মকেই এ পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়। প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ নিয়ে মননশীল শাখা এবং কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে সৃজনশীল শাখা। এ দুই শাখাতে বিজয়ী লেখকরা প্রত্যেকে পেয়েছেন দুই লাখ টাকা অর্থমূল্যের চেক। হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক শাখায় বিজয়ীকে প্রদান করা হয়েছে এক লাখ টাকার চেক। সেই সঙ্গে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে প্রদান করা হয় পদক এবং সম্মাননাপত্র।
২০১১ সালে প্রবর্তিত এ মহাযজ্ঞের ১০ বছরের বৃত্ত পূরণ হয়েছে আগেই। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া অষ্টমবারের আয়োজনের পর পুরস্কারের নিরবচ্ছিন্নতায় ব্যাঘাত ঘটে। মূলত সমগ্র পৃথিবীই তখন তার নিরবচ্ছিন্নতা ভেঙে অভূতপূর্ব এক মহামারির কবলে পর্যবসিত হয়। করোনাভাইরাসের মৃত্যুথাবায় থেমে যায় যেন সমস্ত জীবনসংসার। বাংলাদেশও তা থেকে দূরে থাকতে পারেনি। সাহিত্য পুরস্কারটির নবম আসরের ঠিক প্রস্তুতিকালে করোনার তীব্র ছোবল তছনছ করে দেয় আমাদের জীবন-বাস্তবতাকে। মহামারির ভয়াবহতা আর সামাজিক দূরত্বের বাস্তবতায় আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এবারও যখন সব আয়োজন শেষ, তখন ফুঁসে উঠেছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। কিন্তু সেই ঢেউয়ের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত শুক্রবার পর্দা উঠেছে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানের। এবারের আসরে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে একসঙ্গে দুই বছরের- ২০১৯ ও ২০২০ সালের।
২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে সমগ্র বছরে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে পুরস্কারের জন্য জমা পড়া আট শতাধিক গ্রন্থ হতে নির্ধারিত তিনটি শাখায় নির্বাচন করা হয়েছে সেরা ছয় লেখককে। দেশের প্রথিতযশা চার সাহিত্যিকের সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের বিবেচনায় তারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রায় তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় পূজা সেনগুপ্তের নৃত্য-ভাবনা ও নির্দেশনায় তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটারের নৃত্য দিয়ে। এরপর এমন দহন দিনে কণ্ঠশিল্পী অদিতি মহসিন গেয়ে ওঠেন কবিগুরুর 'বিপুল তরঙ্গ রে'। এই গানে যেন নতুন উজ্জীবন তৈরি হয় হলরুমজুড়ে। একে একে তিনি গেয়েছেন চারটি গান আর জীবনের আবাহনে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন উপস্থিত অতিথিবৃন্দ।
পুরস্কার আয়োজনের আদ্যোপান্ত দুটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশনস ইকরাম কবীর।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কোলাহলমুখর পুরো হলে নিমেষেই নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। ঘোষণা করা হয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিকদের নাম। জুরি বোর্ডের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে নাম ঘোষণা করতে থাকেন আর তুমুল করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে মিলনায়তন। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার-২০১৯ পেয়েছেন প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ ও কথাশিল্পী মোজাফ্ফর হোসেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার 'দীক্ষাগুরুর তৎপরতা' গ্রন্থের জন্য 'প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ' শাখায় এবং হেলাল হাফিজ তার 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' কাব্যগ্রন্থের জন্য 'কবিতা ও কথাসাহিত্য' শাখায় পুরস্কৃত হন। আর মোজাফ্ফর হোসেন তার 'পাঠে বিশ্নেষণে বিশ্বগল্প :ছোটগল্পের শিল্প ও রূপান্তর' গ্রন্থের জন্য পান 'হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার'।
'দীক্ষাগুরুর তৎপরতা' কথাপ্রকাশ, 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' দিব্যপ্রকাশ এবং 'পাঠে বিশ্নেষণে বিশ্বগল্প :ছোটগল্পের শিল্প ও রূপান্তর' গ্রন্থটি পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার-২০২০ অর্জন করেছেন কবি মোহাম্মদ রফিক, গবেষক আফসান চৌধুরী ও রঞ্জনা বিশ্বাস। কবি মোহাম্মদ রফিক তার 'পথিক পরান' গ্রন্থের জন্য 'কবিতা ও কথাসাহিত্য' শাখায় এবং আফসান চৌধুরী তার '১৯৭১ গণনির্যাতন-গণহত্যা :কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর' গ্রন্থের জন্য 'প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ' শাখায় পুরস্কৃত হন। আর রঞ্জনা বিশ্বাস তার 'বাংলাদেশের লোকধর্ম' গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন 'হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার।'
'পথিক পরান' নাগরী প্রকাশনী, '১৯৭১ গণনির্যাতন-গণহত্যা :কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর' কথাপ্রকাশ এবং 'বাংলাদেশের লোকধর্ম' গ্রন্থটি বেহুলা বাংলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
দুই বছরে পুরস্কারের জন্য তিন শাখায় জমা পড়া বই হতে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন; প্রাবন্ধিক, অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস; অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও কবি আবিদ আনোয়ারের সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ড নির্বাচন করেছে ছয় সেরা বই।
দেশের সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতম সেরা এ পুরস্কার ঘোষণা ও বিতরণ অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলেন দেশসেরা সাহিত্যিক, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সাহিত্যমনস্ক বিজ্ঞজন। গুণীজন ও বিশিষ্টজনের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানস্থল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন। জুরি বোর্ডের সম্মানিত সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এবং অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, একটি জাতির সব মানুষের চাওয়া-পাওয়ার অপূর্ব সম্মিলন সাহিত্য। সাহিত্যিকরাই তৈরি করেন আগামীর মননজগৎ। তিনি ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। ব্র্যাক ব্যাংক এবং সমকালকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সাহিত্যিকরা জাতিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে যাবেন।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সংবাদপত্র সঠিক সংবাদ পরিবেশন করে জনগণের অধিকারবোধ ও ক্ষমতা এবং সমৃদ্ধিকেই তুলে ধরে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানা জনগণের অধিকার- সংবাদপত্র তার বাহন মাত্র। সংবাদমাধ্যম এখন অনেক বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির গুণে মুহূর্তের খবর মানুষ মুহূর্তে পাচ্ছেন এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছেন। সমকাল প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে, তারপর থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে আমরা বিভিন্ন কিছুর সমন্বয় ঘটিয়েছি। এরই একটি প্রতিফল ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, যা শুরু হয়েছে ২০১১ সাল থেকে। আগামীতেও সমকালের এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, যারা এ বছর পুরস্কার পেয়েছেন তারা প্রকৃতই এ পুরস্কারের যোগ্য। সমকাল লেখক-সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত করতে পারছে, এটাই আমাদের বড় পাওয়া। গুণীজনকে যে সম্মানিত করতে পেরেছি, সেটিই আমার জন্য বড় আনন্দের এবং গর্বের।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর. এফ. হোসেন বলেন, এ পুরস্কারের দশম আসরে ব্র্যাক ব্যাংককে সঙ্গে রাখার জন্য সমকালকে ধন্যবাদ। লেখক-সাহিত্যিকদের বিশেষ করে তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য আমরা এ পুরস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি। এ পুরস্কার বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ একটি স্থান দখল করেছে। আমরা মনে করি, শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা একটি বিনিয়োগ। ব্র্যাক ব্যাংক সেই বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে।
অনুষ্ঠানে উঠে আসে সমকালের প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের নাম। যার হাত ধরে এ পুরস্কারের যাত্রা শুরু হয়। বক্তারা গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করেন।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ ও ২০২০ জুরি বোর্ডের পক্ষে বক্তব্যে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল কর্তৃপক্ষ বড় একটি কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। আমি আমার সামান্য জ্ঞান দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি বলে গর্বিত। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার এখন আমাদের দেশের স্বীকৃত উঁচুমানের সাহিত্য পুরস্কার। যারা এ পুরস্কার অর্জন করেন তারা আমাদের কাছে অনুসরণীয় ও বরণীয়।
পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। সাহিত্য মানুষকে মিলিত করে, সমৃদ্ধ করে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতাই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য সাহিত্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। প্রযুক্তির ফলে সভ্যতার যে অগ্রগতি হয়েছে, সেখানে প্রযুক্তি সাহিত্য এবং বইকে সহায়তা দিচ্ছে। প্রযুক্তি যতই অগ্রসর হোক, যতদিন এ পৃথিবীতে মানুষ থাকবে, ততদিন বই থাকবে। কারণ, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বইয়ের মাধ্যমেই ফুটে উঠবে। বই মানুষের সঙ্গী। এই সঙ্গী কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বইয়ের অগ্রযাত্রায় একটি দৃষ্টান্ত।
কবি হেলাল হাফিজ বলেন, বাংলা সাহিত্যের বীর রসের কথা কিন্তু নজরুলের বিদ্রোহীও নয়, আমার নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়ও নয়। শ্রেষ্ঠ বীর রসের কথাটি রবীন্দ্রনাথের- 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।' ১৯৮৬ সালে আমার প্রথম কাব্য 'যে জলে আগুন জ্বলে' গ্রন্থের প্রথম কবিতা ছিল- 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'। এ ভূখণ্ডের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল সেই কবিতা। যে সময়ে 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' লিখেছিলাম, যুদ্ধবিরোধী মানুষ হয়েও তখন সেই কবিতা না লিখে উপায় ছিল না। কবিতা দিয়ে মানুষকে ভালোবাসার পথে আনা যায়। আজ মনে হচ্ছে, তা সার্থক। আমাকে সম্মানিত করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পুরস্কৃত আফসান চৌধুরী বলেন, 'আমাকে পুরস্কৃত করার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের দেশে আমরা স্বল্প কিছু মানুষের ইতিহাস রচনা করেছি, এটি রাজনীতির সীমাবদ্ধতার কারণে। বাংলাদেশ জন্মেছে দুইশ বছরের সংগ্রামের কারণে। সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিল কৃষক সমাজ, এই কৃষক সমাজ বিদ্রোহী কৃষক সমাজ। এ কৃষক সমাজ মুক্ত হয়ে গেছে, তাদের মধ্যবিত্তকে দরকার নেই। এ বয়ানটি বুঝতে হলে দুই হাজার বছরের ইতিহাস বুঝতে হবে। এই সংগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে চলছে। একাত্তর হচ্ছে, যে মুহূর্তে এই সংগ্রাম সফল হয়েছে। এটি কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজের নয়, জনগোষ্ঠীর বটে। ফলে লিখতে হলে সবার ইতিহাস লিখতে হবে।'
কবি মোহাম্মদ রফিক বলেন, 'বাংলা ভাষায় যে যা লিখবে, সেটিই বাংলা সাহিত্য। বিভাজন নয়, আমরা চাই সম্মিলন। আমরা চাই একসঙ্গে সবারই অগ্রগতি হোক। আসুন, একসঙ্গে বাংলা সাহিত্য তৈরি করি।'
তরুণ কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, 'লেখার সময় পুরস্কারের বিষয় মাথায় ছিল না। আমি একেবারে প্রান্তিক জায়গা থেকে এসেছি। আমার বেড়ে ওঠা সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে। এমন পুরস্কারপ্রাপ্তি আমার মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিয়েছে।'
তরুণ লেখক ও গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস বলেন, 'এ পুরস্কারের অংশীদার আমি একা নই। এ পুরস্কারের অংশীদার লোকধর্ম সম্প্রদায়ের সবাই। এ ছাড়া প্রকাশক, আমার স্বজন এবং যারা আমাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। এক সময় আমি একজন গৃহিণী ছিলাম। কিন্তু যখন এ পথে নেমেছি, তখন দেখলাম আমি আর একা দাঁড়িয়ে নেই। আমার কাজে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকালকে ধন্যবাদ জানাই।'
দশ বছর পেরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে বলা যায় 'ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারে' ভূষিত সাহিত্যিকবৃন্দ বাংলাদেশের এবং বাংলা ভাষার সমসাময়িক সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব। তাদেরকে সম্মানিত করার মাধ্যমে মূলত বাংলা সাহিত্যের সৃজনচর্চাকেই সম্মানিত করা হয়েছে। প্রাণিত করা হয়েছে ভবিষ্যতের সাহিত্যসাধনার পথকে। এ পুরস্কারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও তাই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে যে সাহিত্যিকরা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, তাদেরকে নিয়মিত উৎসাহিত ও সম্মানিত করার জন্য এ আয়োজনটি এগিয়ে যাবে বছরের পর বছর।
মন্তব্য করুন