বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা; হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা। ভাষা আন্দোলনের মাসে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আমরা কত ধরনের প্রতিজ্ঞাই না করে থাকি! কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা কতটা সচেষ্ট ও আন্তরিক? সন্তান-সন্ততির ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়া কিংবা অনর্গল ইংরেজি বলতে পারা অনেকের কাছে গর্বের বিষয় হতেই পারে। তাই বলে অবশ্যই বাংলা ভাষাকে অবমূল্যায়ন করে নয়। আমাদের একুশের চেতনা হতে পারে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোর বাংলা বিষয়ের সিলেবাস সরকারি তত্ত্বাবধানে এমনভাবে প্রণয়ন করা, যেন শিক্ষার্থীরা অন্তত বাংলা লেখা ও পড়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ উচ্চশিক্ষা, বিশেষত বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে বাংলায় পড়াশোনার সেই অর্থে রসদ নেই। ওইসব লেখাপড়ার পর্যাপ্ত পুস্তক বাংলায় প্রণয়ন বা অনূদিত হয়নি। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করা যায়, সেখানেও পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব রয়েছে।

কিছু ওয়েবসাইট জ্ঞানচর্চা ও রেফারেন্সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। 'এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা' পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলাসহ বহুবিধ জ্ঞানের একটি ইংরেজি বিশ্বকোষ। বর্তমানে প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে ২০০৮ সাল থেকে এটি অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে। একইভাবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি 'ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব কংগ্রেস' এবং 'ইউনেস্কো'র যৌথ উদ্যোগে 'ওয়ার্ল্ড ডিজিটাল লাইব্রেরি' আরেকটি নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার, ২০০৯ সালে ২১ এপ্রিল হোম পেজ উদ্বোধনের মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু করে। এই ওয়েবসাইট ইংরেজি ও আরও দু-একটি ভাষায় তাদের লেখনী প্রকাশ করে থাকে। এ দুটিসহ আরও যেসব ওয়েবসাইট বিশ্বস্ততার সঙ্গে জ্ঞান বিকাশে অবদান রেখে চলেছে, সেগুলোর বাংলা সংস্করণ চালুর জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাহলে বাংলা ভাষায় গবেষণা, রেফারেন্স সংগ্রহ অনেক সহজ হয়ে যাবে।

সংবাদমাধ্যমে বিশেষ করে টিভি চ্যানেলে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা, অনুষ্ঠানাদিতে বিশেষ করে কোনো বিদেশির উপস্থিতি না থাকার পরও অনেক দপ্তরে কোনো কোনো সভা-সেমিনারের স্মার্টনেস ও গ্ল্যামার ধরে রাখার জন্য দাওয়াতপত্র, ব্যানার, সঞ্চালন ও উপস্থাপনা ইংরেজিতে করার প্রয়োজন কী? ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অনেক শহরে কিছু অফিস, দোকান, রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডে বাংলা হরফের দেখা সহজে পাওয়া যায় না। সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত দপ্তরগুলোতে অবশ্য বহু আগেই বাংলায় ফাইলের প্রচলনসহ নোট করার ব্যবহার চালু হয়েছে। বেসরকারি অফিসগুলোতেও পূর্ণভাবে এর প্রচলন ঘটাতে হবে।

যে কোনো পর্যায়ের কোর্টের আদেশ, পর্যবেক্ষণ, রায় একজন দিনমজুর থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির প্রয়োজন হতে পারে এবং হয়ও। কম শিক্ষিত বা লেখাপড়া-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যাদের সরাসরি সংশ্নিষ্টতা নেই, ইংরেজিতে লেখা আদেশ পড়ে বোঝা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাছে দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই কোর্টের সব ধরনের আদেশ বাংলা ভাষায় লেখার বিষয়টি মহামান্য আদালত সদয় বিবেচনায় রাখতে পারেন।

বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোনসহ বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তির বিল বাংলায় রূপান্তর হয়নি। হালে সংযোজিত প্রি-পেইড বিদ্যুৎ মিটারে একটি সংখ্যা ও শব্দ বাংলায় লেখা নেই। সেবা প্রাপ্তির সব বিল ও কাগজপত্র অবশ্যই বাংলায় প্রস্তুত করতে হবে।

ইংরেজি পড়তে না জানা লোককেও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। কিন্তু ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম বাংলায় লেখা হয় না। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট বাংলায় প্রণয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। আমরা তো ইংরেজি টার্মগুলো বাংলা অক্ষরে লেখার প্রচলন ঘটাতে পারি।

বিভিন্ন বিদেশি ভাষার যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গেছে এবং বাংলায় ওগুলোর প্রতিশব্দ আমাদের কাছে দুর্বোধ্য, সেগুলো বাংলা করার দরকার নেই। কিন্তু জোর করে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ছোট এ ভূখণ্ডে আমরা যদি বাংলা চর্চা ও প্রমিত বাংলা অনুসরণ করতে না পারি; ভাষাকে যদি ক্ষতবিক্ষত করতেই থাকি, তাহলে কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করব?

আমরা দেশের সার্বিক উত্তরণের একটি ধাপ অতিক্রম করছি। বিদেশে জনবল প্রেরণ করা হচ্ছে; লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি কারণে অসংখ্য বিদেশি আমাদের এখানে আসছেন। তাঁরা বাংলা জানেন না। আর আমাদের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ইংরেজিতে অভ্যস্ততা নেই। ফলে বিদেশিদের সঙ্গে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় কোথাও না কোথাও কিছুটা হলেও সমস্যা থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে 'গ্লোবাল লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা' ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখার নূ্যনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা সময়ের দাবি বলে মনে হয়।

বাংলা ভাষাকে প্রভাব বিস্তারকারী, সদাপ্রসারমান ও অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে কার্যকর ভাষায় পরিণত করতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি সাধন, মূল্যমান-উত্তীর্ণ সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি শিল্প-প্রযুক্তি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটাতে হবে। শক্তিশালী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে চালকের আসনে উপবিষ্ট হতে হবে। উন্নত সেবাসম্পন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের জনগণের আস্থা অর্জন ও তাদের বাংলাদেশমুখী করতে হবে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ, যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগকারী, পর্যটকদের মনোযোগের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করতে হবে। এ দেশে যত বেশি বিদেশিদের আনাগোনা বাড়বে; আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা বিশ্ববাসীর কাছে তত বেশি পরিচিত হয়ে উঠবে এবং বাংলা ভাষাও বিশ্বভাষায় পরিণত হবে।

সালাহ্‌উদ্দিন নাগরী: সরকারি চাকরিজীবী
snagari2012@gmail.com