মা  য়ের কাছে নীলের বায়না–মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন মা। এমন বায়না সে প্রায়ই করে। মাও শোনান। কিন্তু  মায়ের জানা গল্পগুলো যে ফুরিয়ে গেছে! মা নিজেও তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। মায়ের জন্ম হয়েছে দেশ স্বাধীনের পর। মা নীলকে বলেন, চলো নীল, তোমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে নিয়ে যাই। তিনিই শোনাবেন সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
মায়ের কাছে এমন কথা শোনার পর থেকে নীলের অপেক্ষা। প্রতিদিনই জানতে চায়, কবে যাচ্ছি মা?
মা বলেন, নিয়ে যাবো একদিন।
অবশেষে এলো সেই দিন। মা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নীলকে নিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি। পথে  যানজট। নীলের পিপাসা পায়। মা পানির বোতলের মুখ খুলে দিয়ে বলেন, খারাপ লাগছে?
নীল মাকে অবাক করে দিয়ে বলে, মুক্তিযোদ্ধারা কতো কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করেছেন। আমি যাচ্ছি সেই মুক্তিযোদ্ধার কাছে; একটু কষ্ট তো হবেই মা!
মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আদর করে দেন। একসময় গাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছালো। গাড়ি থেকে নেমে আরো বেশ খানিকটা পথ অটোতে করে গেলো সেই মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি। বাড়িতে পা রাখতেই দেখেন, বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন মুক্তিযোদ্ধা। সামনে ছোট একটা গোল টেবিল। তার পাশে দুইটা চেয়ার। মা আর নীলকে সেই চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন মুক্তিযোদ্ধা। নীল বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর দেখতে। গায়ে জ্যাকেট আর মাথায় টুপি পরে আছেন। সামনের টেবিলে মোটা একটা বই। তার পাশে চশমা খুলে রাখা। চশমা টেনে চোখে দিতে দিতে বললেন, এটা তাহলে তোমার রাজপুত্র, মিলি?
মা হেসে বলেন, জ্বি চাচা! আপনার শরীরটা ঠিক আছে তো? আমার ছেলে সেই কবে থেকে আপনার কাছে আসতে চায় যুদ্ধের গল্প শুনবে বলে। তাই নিয়ে এলাম।
খুব ভালো করেছো মা। গল্পগুলো তো ওদেরই শুনতে হবে। ওরাই বাঁচিয়ে রাখবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। আর দেশটাকে সোনার বাংলা বানাবেও তো ওরাই। কিন্তু  দাদুভাই, মুক্তিযুদ্ধের গল্প তো একদিনে বলে শেষ করা যাবে না! ৯ মাস ধরে এত্তো এত্তো মানুষ যে যুদ্ধটা করলো, তা কি একদিনে বলে শেষ করা যাবে! তুমি মাঝে মাঝেই মাকে নিয়ে আসবে। আমি তোমাকে গল্প শোনাবো। আজ তোমাকে একটা ছোট ছেলের গল্প শোনাই চলো– কদম তোমার বয়সী, সাত-আট বছর হবে। সেও ছিল মুক্তিযোদ্ধা। সে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলো। জানো কীভাবে? আমরা তখন সিলেটের একটা গ্রামের দিকে যুদ্ধ করছিলাম। খবর পেলাম পাকিস্তানি সেনারা বিকেলের দিকে সামনের পথ দিয়ে যাবে। সেই পথে ছিলো একটা কালভার্ট। আমরা ঠিক করলাম ওদের গাড়ি যখন কালভার্টে উঠবে, তখন আমরা কালভার্টটা ধ্বংস করে দেবো। তো আমরা পজিশন নিলাম। তখনো দিনের আলো দেখা যাচ্ছে। তাই আমাদের পজিশন নিতে খুব সমস্যা হচ্ছিলো। তবুও যতোটা পারি আমরা লুকিয়ে, নিজেদের শুকনা পাতা, ডাল দিয়ে ঢেকে পজিশনে থাকলাম। সময় হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি আসছে। তখন আমাদের দলের একজন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তা পেরিয়ে ওপার থেকে এপারে আসার সময় তার হাত থেকে রাইফেলটা পড়ে যায় রাস্তায়। কিন্তু  তার আর সময় ছিলো না ওটা উঠিয়ে নিয়ে আসার। তখন কোথা থেকে একটা ছোট ছেলে বাতাসের মতো ছুটে এসে অস্ত্রটা তুলে এনে আমাদের কাছে দিলো। আমরা তখন ফায়ার করছি! আমরা আগেই মাইন পুঁতে রেখেছিলাম। ওদের গাড়ি কালভার্টে উঠতেই মাইন ফাটিয়ে দিলাম। পুল ভেঙে পড়লো। আর ওদের গাড়িটা উড়ে গিয়ে পড়লো পানিতে। জানো, সেই গাড়িতে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের সবাই মারা গিয়েছিলো! আর অপারেশনে সেই ছোট ছেলেটাই ছিলো নায়ক! আমরা ওকে মাথার ওপরে তুলে উল্লাস করেছিলাম। তারপর থেকে ও আমাদের সঙ্গেই থাকতো। আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম বল্টু! ছোট্ট যোদ্ধা বল্টু।