
বিন্দি বাংলা ভাষার শব্দ নয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম বিন্দি নামের একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তাঁর লেখা ‘রাক্ষুসী’ ছোটগল্পে। ঠিকই আছে। কারণ, লেখক গল্পের শুরুতে বলেই দিয়েছেন, বীরভূমের বাগদিদের ভাষায় গল্পটি লেখা। দেখা গেল, শুধু ভাষা নয়, চরিত্র-পরিবেশ-সংসার সবই নিয়েছেন তিনি অবাঙালি পরিমণ্ডল থেকে। তাই কোনো বাঙালি নাম নয়, বিন্দি নামটি এলো মুখ্য চরিত্রে। কপালের ছোট আকারের গোল টিকা বা টিপকে হিন্দিতে বিন্দি বলে। নামটি বেশ প্রতীকী। গল্পে দেখা যাচ্ছে, এই বিন্দি সূর্যের মতো শুধু বড়ই নয়, উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছে!
যে সময় নজরুল এই ছোটগল্প লিখেছেন এবং পুরুষের বিপথগামিতার বিরুদ্ধে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃষ্টান্ত সৃজন করেছেন, সে সময় এই চেতনা বাংলা কথাসাহিত্যে খুব একটা দেখা গেছে বলে মনে হয় না। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের যখন কাজী নজরুল ইসলামের ছোটগল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ বের হয়, তখনও কিন্তু এক অর্থে বাংলা ছোটগল্পের গড়ে উঠবার কালই। এই গড়ে উঠবার কালের একজন সারথি হলেন নজরুল– যিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতার সাথে আবেগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে চমৎকার প্রকাশ-উপযোগী আঙ্গিকে বাংলা ছোটগল্পকে দান করেন গতি ও বিভূতি। বাংলা ছোটগল্প সৃষ্টি হয়েছিল প্রথার আনুগত্যে নয়, বিরোধিতার প্রচণ্ডতাতেও নয়– আত্ম-উন্মোচনের স্বতঃস্ফূর্ততায়। কাজী নজরুল ইসলামের আগে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তাঁর পরে দণ্ডায়মান বিশ শতকের তিরিশের দশকের ছোটগল্পকারবৃন্দ। অর্থাৎ একদিকে রবীন্দ্রনাথ অন্যদিকে বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পের তীর– যেন এক নদীর দুই কূল। উভয় কূলের মাঝখানে নজরুলের সৃষ্টি। এখানে নজরুল সাঁকোর কাজ করেছেন; দুই তীরকে দিয়েছেন সংযুক্তি। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে, মাত্র এক বছরে নজরুলের ছয়টি ছোটগল্প (‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’, ‘স্বামীহারা’, ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের-নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’) পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এই ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকত তাহলে নজরুলের হাতে বাঙালি পাঠক অন্তত শতাধিক ছোটগল্প পেতই। কিন্তু এর এক-চতুর্থাংশও লেখেননি নজরুল। কারণ, একসময় তিনি ছোটগল্পের জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে আত্মহারা হয়ে গেলেন কবিতা ও গানের পুষ্পবাগিচায়।
নজরুলের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘রিক্তের বেদন’ (প্রকাশকাল: ১৯২৪)-এর অন্তর্ভুক্ত গল্প ‘রাক্ষুসী’। শুধু নামে নয়– ভাষা, উপস্থাপনা, দৃষ্টিভঙ্গি– সবকিছুতেই এখানে একেবারে ভিন্নমাত্রা আনেন নজরুল। ‘রাক্ষুসী’ ছোটগল্পে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী বিন্দির জীবনযাপন ও স্বামী হত্যা করে জেলে গমনের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম একটি বিশেষ সমাজ ও সময়ের নারীজীবনের বাস্তবতার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাপন তুলে ধরেছেন। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষায় উল্লেখকৃত গল্পটি প্রকৃত অর্থেই ভিন্নমাত্রার। বিশ শতকের তিরিশের দশকে অনেকেই গল্পে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ করেছেন সত্য, কিন্তু তাঁদেরও আগে একটি পুরো ছোটগল্পে আদিবাসীদের ভাষার ব্যবহার পাওয়া যায়নি। প্রচলিতভাবে গল্পের ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। বাগদি নারী বিন্দি পরনারীর প্রতি প্রেমাসক্ত তার স্বামীকে সেই কর্ম থেকে ফেরাতে না পেরে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে– এটাই ছোটগল্পটির মূল ঘটনা। বিন্দি বিশ্বাস করে, এতে সে ঠিক কাজই করেছে। স্ত্রীর নানাবিধ কর্তব্যের মধ্যে স্বামীকে নরকে গমন থেকে ফেরানোও তার কর্তব্য। এই বোধটি ঠিক কিনা, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। নজরুল বিন্দিকে দিয়ে যে প্রতিবাদটি করিয়েছেন, সেখানে অধিকার-চেতনা বা আত্মজাগরণের চেয়ে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যবোধই যেন প্রকাশ পেয়েছে। বিন্দি বলেছে, তার স্বামী পাপকর্মের জন্য এক পা এক পা করে নরকে নেমে যাচ্ছিল। স্বামীকে নরকগমন থেকে ফেরানো স্ত্রীর কর্তব্য বিধায় বিন্দি স্বামী হত্যা করে স্বামীকে নরকগমন থেকে ফিরিয়েছে– এই বোধটি কিন্তু প্রশ্নমুক্ত নয়। কিন্তু কোনো নৃগোষ্ঠীতে এই বোধ থাকতেও পারে! গল্পে বিন্দি বলেছে– ‘আমি তার ইস্ত্রি, আমারও তো একটা কর্তব্য আছে, আমার সোয়ামি যদি বেপথে যায়, ত আমি না ফিরালে অন্য কে এসে ফিরাবে? আর সে এই রকম বেপথে গেলে ভগবানের কাছে ধর্মত আমিই তো দায়ী।’ এখানে হত্যার চেয়েও সবচেয়ে বড় যে কথাটি তা হলো, ধর্মবোধ এবং নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার। নারী এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছে– যে সিদ্ধান্ত নেওয়া অধিকার সমাজ সাধারণত নারীকে দেয় না। কাজী নজরুল এই হত্যাকাণ্ডটি প্রতীকী হিসেবেই তুলে ধরেছেন। হত্যা সমস্যার সমাধান নয়– এ বোধ নজরুলের ছিল। কিন্তু তার পরও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। স্ত্রী ও তিনটি সন্তান থাকার পরও পুরুষ অন্য নারীতে আসক্ত হলে সমাজ কুপিত হয় না, কিছু প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করে না। অন্যদিকে বিন্দির যেন সব দোষ! সাত বছর জেলে থাকার পরও সমাজ তাকে রাক্ষুসী বলে অভিহিত করে। অথচ, এই নারী খেয়েপরে থাকার মতো একটি একটি সরল জীবন চেয়েছিল। সন্তানদের ভবিষ্যৎ যাতে সুন্দর হয় সে কারণে তাদের বিয়ে ও সংসার নিয়েও ভেবেছিল। এই সুন্দর চিন্তা তার স্বামীর বিপথগামিতার জন্য ব্যাহত হয়। কিন্তু সমাজ তার স্বামীকে সুপথে পরিচালনার জন্য কোনো বার্তা দেয়নি। ফলে এর প্রতিবিধান করতে হয়েছে বিন্দিরই। আদতে গল্পটি একটি প্রতিবাদ; রাক্ষস-সমাজের বিরুদ্ধে নারীমূর্তির রণরঙ্গিণী খড়্গহস্ত! ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহার ও যাপিত জীবনের উল্লেখ গল্পটিকে অনন্য করেছে। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধেও প্রবল বক্তব্য আছে এখানে। বিন্দি স্বামী হত্যার পর তার মাখনদির উদ্দেশে বলেছে– তার কর্মের বিরুদ্ধে পুরুষেরা চিৎকার করবেই। নারীরা করলেই শত দোষ আর পুরুষেরা সবকিছু করতে পারে বলে সমাজ মনে করে। পরপুরুষে যদি কোনো নারী লিপ্ত থাকে এবং তাকে যদি হত্যাও করা হয় তাহলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুরো সমাজ নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু পুরুষের ওপর কোনো আঘাত এলেই, যদি সে পরনারীতে লিপ্ত থাকার মতো সমান দোষও করে, তার পরও এর প্রতিবাদ হবে না? সাধারণত হয় না। কারণ, বিন্দি দেখে এসেছে– ‘পুরুষদের সাত খুন মাফ।’ এরই প্রতিবাদ করেছে সে।
নিজের প্রতি চরম অন্যায় হলে নারীরাও যে ক্রোধোন্মত্ত হতে পারে এবং সমাজে দেবতা হিসেবে স্বীকৃত স্বামীর ইহলীলা সাঙ্গ ঘটাতে পারে– এ ব্যাপারটি ঝাঁকুনি দেবার মতো। সমাজে সে ঝাঁকুনি পড়েছিল বটে কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাতেও দমেনি। স্বামী হত্যার অপরাধে শাস্তি ভোগ করে সমাজে ফিরে আসার পর গ্রামবাসী তাকেই ‘সাক্ষাৎ তাড়কা রাক্ষসী’ বলে অভিহিত করে আর তার সঙ্গে করে চরম বিরূপতা। সাত বছর জেল খেটে সমাজে ফেরার পরও বিন্দিকে সমাজ তুচ্ছজ্ঞান করার কারণ কী? কারণ একটাই, সমাজটি পিতৃতান্ত্রিক আর নারীটি একজন পুরুষকে হত্যা করেছে। বিন্দির সন্তানদের প্রয়োজনীয় সামাজিক মর্যাদা পেতে অসুবিধেও হয়। তার কন্যার বিয়ে হয় না এ কারণে যে, সমাজ প্রচার করে মায়ের মতো মেয়েও স্বামীঘাতী হতে পারে। এমনকি মায়ের অপরাধে তার পুত্রকেও সমাজ একঘরে করে। নারীর অপরাধে তার পুরো পরিবার যেন অভিশাপে দগ্ধ হয়। সমাজের কঠোর নিয়ম ও অনুশাসন পুরুষের ক্ষেত্রে নয়, শুধু নারীর জন্য– পরোক্ষভাবে নজরুল যেন সেই কথাই ব্যক্ত করেছেন এই ছোটগল্পে। কিন্তু বিন্দির সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রতিবাদে যে আলো আর তেজ তা পাঠককে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে ডাক দেয়– বিন্দি থেকে করে সূর্য!
বিষয় : প্রচ্ছদ সৌমিত্র শেখর
মন্তব্য করুন