- সাহস
- গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আফরিন
ঠিকানার খোলা আকাশে ২২০ ফুট দৈর্ঘ্যের ফুলের শহীদ মিনার
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আফরিন

আফরিন তাইয়ি্যবা আলিফ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষাশহীদদের স্মরণে রাজধানীর বেরাইদে ঠিকানা রিসোর্টে ২২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩৪ ফুট প্রস্থের তাজা রঙিন ফুলের শহীদ মিনার তৈরি করেন এই শিক্ষার্থী। এই শহীদ মিনারের খোঁজ রেখেছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে তারা আসছেন পর্যবেক্ষণে। ঠিকানা রিসোর্ট ও শহীদ মিনারের গল্প শুনেছেন আশিক মুস্তাফা
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফরিন তাইয়ি্যবা আলিফ। রাজধানীর বেরাইদে গড়ে তুলেছেন ঠিকানা রিসোর্ট। ভাষার মাসে সেই রিসোর্টে ২২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩৪ ফুট প্রস্থের তাজা রঙিন ফুলের শহীদ মিনার তৈরি করেন এই শিক্ষার্থী। এত বড় স্মৃতিস্তম্ভ এশিয়ার কোথাও নেই। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ আগামী দু-এক দিনের মধ্যে আসছে তাঁর তৈরি এই শহীদ মিনার পর্যবেক্ষণে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
আফরিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দাদার বাড়ি ঢাকার বেরাইদে। এই বেরাইদেই তিনি গড়ে তুলেছেন ঠিকানা রিসোর্ট। আফরিন পড়েছেন স্থানীয় সাঁতারকুলের স্যার জন উইলসন স্কুলে। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে বর্তমানে বিবিএ করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বাবা আলিফ আহমেদ খান একজন ব্যবসায়ী। মা আফরোজা বেগমও সামলাচ্ছেন খানস কিচেন নামে পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় আফরিন। পরিবারের কাছ থেকেই পেয়েছেন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকে সেই স্বপ্নের পথেই ছুটছেন তিনি!
যেভাবে গড়ে তোলেন শহীদ মিনার
আফরিন নিজের স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করতে চান নিজের মতো করেই। তাই তো তাঁর ভাবনা অনেকের সঙ্গে মিলে গেলেও কোথাও আবার একটু অন্য রকম। এই অন্য রকম ভাবনাতেই তাঁর তৃপ্তির ঢেঁকুর। আফরিনের তৈরি ২২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৫ ফুট উচ্চতার এই শহীদ মিনার মূলত কাঠ ও বাঁশের অবকাঠামোতে তৈরি। তারপর সাজানো হয় ফুল দিয়ে। ২০ জনের মেধা ও অক্লান্ত শ্রমে এটি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এতে ব্যবহার করা হয় ১২ হাজারের বেশি ফুলের টব, যার প্রতিটিতে রয়েছে ২০টি ফুল। লাল, নীল, সবুজ, সাদাসহ ছয় রঙের জাপানি পিটুনিয়া ফুলগাছ দিয়ে একের পর এক সাজিয়ে শহীদ মিনারের এ প্রতিকৃতি বানানো হয়েছে।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের পথে...
শহীদ মিনার সম্পর্কে জানতে চাইলে আফরিন তাইয়ে্যবা আলিফ বলেন, 'আমি প্রকৃতি ও ফুল নিয়ে কাজ করি। তাই চেয়েছি ইতিহাসকেও ফুলের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে। ভাবলাম ভাষার মাস আসছে, ভাষাশহীদদের প্রতি ফুলেল শুভেচ্ছা হিসেবে একটি শহীদবেদি নির্মাণ করি। উদ্দেশ্য, গোটা বিশ্ব যেন এই সৃজনশীল কাজ সম্পর্কে জানতে পারে। শহীদ মিনার নির্মাণ করতে গিয়ে দেখলাম, অনেক ফুল প্রয়োজন। এমন বড় স্মৃতিস্তম্ভ এশিয়ার কোথাও নেই। তখনই মাথায় আসে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানোর বিষয়টি।'
গিনেস কর্তৃপক্ষের তদারকি
২০২২ সালে প্রথম এমন শহীদ মিনার গড়ে তোলেন আফরিন। এবার দ্বিতীয়বারের মতো তৈরি করেন ফুলের এই শহীদ মিনার। ২০২২ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি পেতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন আফরিন। সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আফরিন বলেন, 'গিনেসে নাম লেখানোর আগ্রহ দেখানোর পর তারা আমাদের কাছে কিছু ডকুমেন্ট চেয়েছে। ছবি, ভিডিও ফুটেজ, মিডিয়া কভারেজসহ আরও বেশ কিছু কাগজপত্রও চেয়েছে। এখানে কী পরিমাণ ফুল লেগেছে, কত রকমের ফুল আর শহীদ মিনারের আকৃতি বা আয়তন ইত্যাদির সব তথ্য ওদের সরবরাহ করি। ওরা যাচাই করার জন্য আসবে হয়তো এই সপ্তাহেই। এর জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।'
ঠিকানার যেখানে শুরু
২০১৯ সালে শুরু ফুলেল ঠিকানার পথচলা। ঠিকানার মূল অবকাঠামো আনা হয় মুন্সীগঞ্জ থেকে। এই অবকাঠামোটি মূলত বাসযোগ্য একটি বাড়ি। বাড়িটিকে দেওয়া হয় রেস্টুরেন্টের আকার। এরপর একে একে জাপানি ফুল পিটুনিয়া ও গাঁদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় কাঠামোটি। তা খুবই সাড়া ফেলে দর্শনার্থীর মধ্যে। প্রকৃতির প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, তা ঠিক আঁচ করতে পেরেই ঠিকানাকে ফুলে ফুলে আবৃত করার পরিকল্পনা করেন আফরিন। সেই পরিকল্পনার পালে হাওয়া দিতে ২০২১ সালে পিটুনিয়া ও গাঁদা ফুলের পাশাপাশি ডায়ানথাস, চন্দ্রমল্লিকাও যুক্ত হয়। মানে শীত মৌসুমের ফুলগুলো দিয়ে রাঙানো হয় ঠিকানাকে। সেই সঙ্গে শীতে আয়োজন করা হয় ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যালেরও। তা দেখতে এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়েন মানুষ!
যেই ভাবনায় ঠিকানা গড়ে ওঠা
আফরিন তাইয়ে্যবা আলিফ বলেন, "পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে অবসর সময় কাটানোর ভাবনা থেকেই ঐতিহ্যবাহী নকশায় গড়ে তোলা হয় 'ঠিকানা'। ঠিকানার মূল কাঠামো বা বাড়িকে ঘিরে লাগানো হয়েছে দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ। রাজধানীর মধ্যে এমন গ্রাম্য পরিবেশ দেখতে ছুটে আসেন অসংখ্য মানুষ। দিন দিন এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকায় আমরা বাড়িটির পরিধি বাড়াতে থাকি। বাড়ির পাশে কাঠের পাটাতনের বিশাল জায়গাও ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলি। এ অংশের নাম দেওয়া হয় 'খোলা আকাশ'। এই খোলা আকাশের একটি অংশেই ফুলের শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি গড়ে তুলি। পাশাপাশি গ্রাম্য পরিবেশে খাওয়া ও সময় কাটাতে আরও একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে এখানে। যেখানে নানা ধরনের ভর্তা দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়। আছে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঝড় তোলার মতো আড্ডার জায়গা। পাশাপাশি সুবিশাল খোলা জায়গা রাখা আছে, যেখানে মানুষ মন খুলে চলাফেরা করতে পারেন। আর পুরো ঠিকানা ও খোলা আকাশ জায়গাটিকে আমরা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলেছি।"
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে আফরিন তাইয়ে্যবা আলিফ বলেন, 'দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে ঠিকানার প্রতি। শুরুর তুলনায় জায়গা বাড়লেও এখন ফের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এর আকার আরও বড় করার। আমরা সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখছি। সব সময় মানুষের কথা মাথায় রেখেই ঠিকানাকে সাজানো হয়। আমরা নিয়মিত ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল করছি। এই ফেস্টিভ্যালে ফুলের সংখ্যা আরও বাড়াতে চাই আগামীতে। চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফুল আনার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া শহীদ মিনার প্রতিবছর তৈরি করতে চাই। শুধু তাই নয়, আগামীতে আরও বড় করে তৈরি করতে চাই শহীদ মিনার। এতে করে বিশ্বের মানুষ আরও ব্যাপকভাবে জানতে পারবে আমাদের ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের কথা।'
মন্তব্য করুন