- সাহস
- পরিশ্রমই সাফল্য এনে দেয় জীবনে
পরিশ্রমই সাফল্য এনে দেয় জীবনে

লিসা ফনসাগ্রিবস। পৃথিবীর প্রথম সুপারমডেল হিসেবে পরিগণিত সুইডিশ এই কিংবদন্তি ফ্যাশন মডেলের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রেরণামূলক কথা তুলে এনেছেন মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ
আমার আদর্শ পাঠশালা
মনে পড়ে, জার্মান ড্যান্সার ও কোরিওগ্রাফার মারি ভিগমানের কাছে নাচ শিখতে বার্লিন পাড়ি জমিয়েছিলাম আমি। এক ধরনের সুবিস্তৃত আর্ট স্কুল ছিল তার, যেখানে শুধু নাচই নয়, বরং স্টুডিও আর্ট, শিল্প-ইতিহাসসহ শিল্পের সংশ্নিষ্ট প্রায় সবকিছুই শেখানো হতো আমাদের। আমার বাবা-মা ভীষণ শিল্পানুরাগী ছিলেন। শৈশবের ছুটির দিনগুলো আমার কেটেছে তাদের সঙ্গে ইউরোপের নানা প্রান্তের মিউজিয়াম ঘুরে দেখে। বাবা ছবি আঁকতেন; আমাকে আর বোনদেরও উৎসাহ জোগাতেন আঁকতে। আমার মা ভীষণ সৃজনশীল এক মানুষ ছিলেন। আমাদের সব পোশাক তিনি নিজেই বুনতেন; আর তৈরি করে রাখতেন জাদু ও সৌন্দর্য ছড়ানো এক চমৎকার আবহ। সেটির প্রভাবে ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, আমাকে এমন কিছু করতে হবে, যেটি একান্তই আমার গড়া জগৎ হয়ে উঠবে। ফলে ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে, ভাস্কর্য বানাতে আর নাচতে ভালো লাগত আমার। তাই মারি ভিগমানের স্কুলটার কথা শুনে মনে হলো, নিশ্চয় এটি আমার আদর্শ পাঠশালা। মারিকে চিঠি লিখলাম। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার বাবা-মাও আমাকে খুশিমনে যেতে দিলেন। এর পর সেখান থেকে স্টকহোমে ফিরে নিজের একটা ড্যান্স স্কুল খুললাম আমি।
ব্যালের পাঠ...
তখনকার দিনে অস্ট্রিড মামবরি নামে এক বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার ছিলেন সুইডেনে। প্যারিসের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ডাক পেলাম তার কাছ থেকে। সেখানে বড় ধরনের খ্যাতি ও সম্মান পেলাম আমরা। মুহূর্তেই শহরটির প্রেমে পড়ে গেলাম। ঠিক করলাম, এখানেই থেকে গিয়ে মডার্ন ড্যান্সের পাশাপাশি নাচের অন্যান্য ফর্মের ওপর পাঠ নেব। ফলে প্রিন্সেস ইগোরোভা নামে রাশিয়ান এক অসাধারণ শিক্ষয়িত্রীর কাছে নিলাম ব্যালের পাঠ। আমাদের ক্লাসে মিয়া স্লাভেন্সকাও ছিলেন। কী যে চমৎকার নাচতেন তিনি! এ ছিল আমার জন্য এক অন্য রকম অনুপ্রেরণা।
মডেল হওয়ার প্রস্তাব
এ সময়েই আমার প্রথম স্বামী ফারনান্ড ফনসাগ্রিবসের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনিও ড্যান্সার ছিলেন। আমরা একসঙ্গে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতাম প্রাইভেট লেসন দিতে। একদিন, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন বাড়ি ফিরছি, এলিভেটরে নিজেকে ফটোগ্রাফার পরিচয় দিয়ে এক ভদ্রলোক আমাকে মডেল হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। তিনি আমাকে পোজ দিতে বলছেন- এ কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম ঠিকই, পাশাপাশি হলাম শিহরিত। তখনও খুব অল্পবয়সী আর মার্জিত এক মেয়ে আমি! যা হোক, ভিলি মেভাল্ড জার্মান কিংবদন্তি ফ্যাশন ফটোগ্রাফার নামের সেই ভদ্রলোক কিছু ছবি তুললেন। আমার স্বামী সেগুলো হাতে পেয়ে জমা দিয়ে এলেন 'ভোগ' ম্যাগাজিনে।
স্ট্ক্রিন টেস্টে আমন্ত্রণ
তারা আমাকে হর্স্টের মানে হর্স্ট পি. হর্স্ট- জার্মান-আমেরিকান ফটোগ্রাফারের কাছে স্ট্ক্রিন টেস্ট দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। উত্তেজনা ও উদ্বেগে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হলাম আমি। এর আগে কোনোদিনই কোনো ফ্যাশন ম্যাগাজিন দেখা হয়নি আমার; এমনকি জানতামও না- ফ্যাশন কাকে বলে! নিজের পোশাক-আশাক নিয়েই হাজির হলাম আমি। মনে পড়ে, আমার পরনে ছিল ডার্ক ব্রাউন উলের একটি স্যুট, মাথায় এলোমেলো দীঘল চুল। এক কথায়, টেস্টের জন্য আমি ছিলাম একেবারেই বেমানান। আমার চুল নিয়ে কী করবেন- বুঝে উঠতে পারছিলেন না কেউ। আর আমি সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়লাম নিজের হাত দুটি নিয়ে- পোজ দেওয়ার সময় কীভাবে যে রাখব! যদিও নিজেও ছিলেন অল্প বয়সী ও অনভিজ্ঞ হার্স্ট আমাকে নিরন্তর উৎসাহ জুগিয়ে গেলেন, তবু বুঝতে পারছিলাম না- ঠিক কী করব আমি!
'ভোগ' থেকে ডাক
সেই টেস্টের পর আমি সরাসরি ল্যুভর মিউজিয়ামে ছুটলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম একেক ধরনের পোশাক একেক মানুষ কীভাবে সামলায়। বিশেষ করে, সান্ধ্যকালীন পোশাক। পরের দিনই 'ভোগ'-এর কাছ থেকে মিটিংয়ে বসার ডাক এলো। সামনে রাখা হলো বিখ্যাত ডিজাইনারের অতিসূক্ষ্ণ গাউনগুলো। সেটা ১৯৩৬ কিংবা ১৯৩৭ সালের কথা। দেখে ভাবতেও পারছিলাম না- কোন ধরনের নারীরা এমনতর পোশাক পরতে পারে! পরতেই মনে হলো, আমি একেবারেই আলাদা একটা মানুষ। সেটে যাওয়ার আগে ড্রেসিংরুমের আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে। আর ফটোগ্রাফারের চোখে ধরা পড়া খুঁতগুলো নিজের মতো সামলিয়ে উঠলাম। এ ছিল আমার জীবনের অনন্য এক অভিজ্ঞতা। আসলে পরিশ্রম যে কোনো বয়সেই সফলতা এনে দিতে পারে!
মন্তব্য করুন