- সাহস
- এমআইটিতে চাঁদপুরের নাফিস
এমআইটিতে চাঁদপুরের নাফিস

নাফিস উল হক সিফাত। এখনও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হননি। চাঁদপুর সরকারি কলেজের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে তাঁর এমআইটি যাত্রার গল্প শুনেছেন ইকবাল পাটোয়ারী ও ফয়সাল হাবিব
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি এমআইটিতে আবেদন করেছিলেন নাফিস উল হক সিফাত। যদিও আবেদনের সেটিই ছিল শেষ দিন। এমআইটিতে আবেদনের জন্য তাঁকে স্যাট পরীক্ষার স্কোর জমা দিতে হয়েছে। স্যাটে তাঁর স্কোর ছিল ১ হাজার ৫০০। ইংলিশ প্রফিসিয়েন্সি টেস্টের পাশাপাশি দিতে হয়েছে বেশ কিছু রচনা এবং রিকমেন্ডেশন লেটার। দিতে হয়েছে এমআইটির ভর্তি প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রমাণ করতে একটি সাক্ষাৎকারও। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা। অবশেষে ১৫ মার্চ রাত সাড়ে ৪টায় পেলেন এমআইটি থেকে কাঙ্ক্ষিত মেইল। এমআইটির মেইল পাওয়ার পর কেমন লাগছে তা জানতে চাইলে সিফাত বলেন, ‘চিঠি পাওয়ার পর অন্যরকম লাগছে। আসলে এমন সংবাদ কার ভালো না লাগবে। আমি কখনও ভাবিনি, বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়ার সুযোগ পাব। আসলে আমি অনেক লাকি। কারণ, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর একজন বা দু’জন এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পান। এতে আমি অবাক হয়েছি, আনন্দিতও হয়েছি। এ জন্য আমার বাবা-মা, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে কৃতজ্ঞ।’
শৈশব ও বেড়ে ওঠা
নাফিস চাঁদপুরের ছেলে। শহরের চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় হাসান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয় থেকেই বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। বর্তমানে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। নাফিসের বাবা-মা দু’জনই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। বাবা মো. নাসিরউদ্দিন স্থানীয় রয়মনেন নেসা মহিলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক। আর মা কামরুন নাহার হাজীগঞ্জ মডেল কলেজের রসায়নের শিক্ষক। তিন সন্তানের মধ্যে নাফিস দ্বিতীয়। নাফিসের বড় বোন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ছোট ভাই পড়ছে মাধ্যমিকে।
শিক্ষামন্ত্রীর অভিনন্দন পেলেন নাফিস
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে চাঁদপুর সরকারি কলেজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নাফিসকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নাফিস কেবল চাঁদপুরের নয়, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। সে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সবসময় তার পাশে থাকব আমি।’
চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অসিত বরণ দাস বলেন, ‘আমার কলেজের নাফিস এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছে এ জন্য যে, তার চেষ্টা ছিল। কারণ, সে সবসময় বিজ্ঞানবিষয়ক পড়াশোনা বা গবেষণা নিয়ে আগ্রহী। তারই প্রতিফলনে এই সাফল্য এসেছে।’
যত অর্জন
নাফিস মাধ্যমিক থেকে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের সঙ্গে। সাফল্যের ঝুড়িও বেশ ভারী। তাঁর অর্জনের কথা জানতে চাইলে নাফিস বলেন, ‘সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে আমি মূলত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতাম। এগুলোর মধ্যে আমি নিয়মিত ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করি। তবে আমার শেখাতেও বেশ ভালো লাগে। তাই প্রায়ই প্রোগ্রামিংসহ অ্যালগরিদমের ওপর বিভিন্ন গ্রুপ বা কোর্সে ক্লাস নিতাম। ২০১৯ সাল থেকে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেছি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম ২০২১ সালে ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দলে সুযোগ পাই। আর সে বছরই একটি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলাম। পরের বছর আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে আবারও একটি ব্রোঞ্জ পদক পাই। পাশাপাশি আমি গণিত অলিম্পিয়াডেও অংশগ্রহণ করতাম। ফলে ২০২১ ও ২০২২ সালে জাতীয় ক্যাম্পের জন্য মনোনীত হয়েছিলাম।’
বর্তমান ব্যস্ততা
বর্তমান ব্যস্ততার কথা জানতে চাইলে নাফিস বলেন, ‘এতদিন আসলে পড়াশোনা করতে হয়েছে। মাত্র আমাদের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই তেমন কিছু করা হয়নি। পরীক্ষা শেষ হলো কেবল, এই ছুটিতে কী করব তা এখনও ঠিক করিনি। তবে সামনে বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব শুরু হবে। তার প্রস্তুতি শুরু করব।’
নাফিসের চোখে এমআইটির যোগ্যতা
এমআইটিতে পড়তে হলে কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, এমন প্রশ্নে নাফিস বলেন, ‘অনলাইনেই সব তথ্য পাওয়া যায়; তবে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট কোনো যোগ্যতা আছে কিনা আমার জানা নেই। সাধারণত এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষার্থী বা পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে এমন যে কেউ আবেদন করতে পারে। তা ছাড়া এমআইটিতে আবেদন করতে স্যাট দিতে হয়। তবে যেহেতু বেশিরভাগ আবেদনকারীরই একাডেমিক এবং স্যাট স্কোর ভালো থাকে, তাই সঙ্গে কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস অলিম্পিয়াড, বিতর্ক প্রভৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত আমার পরিচিত যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এমআইটিতে সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের সবাই কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে পদকজয়ী ছিলেন। যাঁরা এমআইটিতে পড়তে চান তাঁদের উদ্দেশে বলব, বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিতে যোগ দেওয়া; যেমন– গবেষণা আর অলিম্পিয়াডকে এমআইটি খুব গুরুত্ব দেয়।’
আগামীর স্বপ্ন
নাফিসের ইচ্ছা কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ার। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরু হবে নাফিসের। তার আগেই পৌঁছাতে হবে এমআইটির ক্যাম্পাসে। পড়াশোনা ও আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে নাফিস বলেন, ‘আপাতত পড়াশোনায় মন দিতে চাই। পড়া শেষে অবশ্যই দেশে ফিরে আসব। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। কারণ, আমার মূল অনুপ্রেরণাদাতারাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। বলছি, জাফর ইকবাল স্যার, কায়কোবাদ স্যার, মাহবুব মজুমদার স্যার, সোহেল রহমান স্যারদের কথা। আমি খুব অবাক হয়ে দেখি, তাঁরা তাঁদের সবটুকু দেশের জন্য কীভাবে দেন! আমার জীবনে এই কয়েকজন মানুষের অবদান এত বেশি যে, আমি সবসময় বড় হয়ে স্যারদের মতো হতে চাইব।’
মন্তব্য করুন