ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

গুগলের পণ্য ব্যবস্থাপক শাম্মী

গুগলের পণ্য ব্যবস্থাপক  শাম্মী

শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস -ছবি: সংগ্রহ

ইমাম হোসেন মানিক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৪

শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস। গুগলের পণ্য ব্যবস্থাপক ও ইয়ুথ লিডার প্রোগ্রাম ‘বিওয়াইএলসি গ্র্যাজুয়েট নেটওয়ার্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা এই স্বপ্নবাজের স্বপ্নযাত্রার কথা তুলে এনেছেন ইমাম হোসেন মানিক

গুগলে পণ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস। তাঁর কাজ হলো, একটি পণ্য ‘কী’, তা সংজ্ঞায়িত করা। মূলত শাম্মীর পরামর্শ নিয়েই ইঞ্জিনিয়ারিং দল প্রযুক্তিগত বাস্তবায়নের নকশা করেন। শাম্মী পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে। 
বেড়ে ওঠা
মা-বাবা দু’জনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ায় শাম্মীর শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামেই। তবে মা-বাবা তাঁকে কখনোই ভালো গ্রেড আনতেই হবে, এমন কোনো চাপ দেননি। তারা বরং সব সময় সাহস জুগিয়েছেন। শাম্মীর মা ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, তাই গণিত ও বিজ্ঞান শেখার হাতেখড়ি তাঁর হাত ধরেই। খাওয়ার টেবিলে আলোচনা চলত নিউটনের পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব নিয়ে। মেয়েকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘তুমি কি জানো, তোমার ওজন থাকার পরেও চেয়ারটা কেন ভেঙে পড়ছে না?’– এ জাতীয় প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে মা বিজ্ঞানকে মেয়ের দৈনন্দিন জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলেছিলেন। অন্যদিকে বাবা ছিলেন বইপ্রেমী। দুই সপ্তাহ পরপর মেয়েকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে নিয়ে যেতেন বই আনার জন্য। চট্টগ্রামে বই কোলে নিয়ে বাবার সঙ্গে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো সেই বিকেলগুলো তাঁর কাছে এখনও সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি। মূলত মা আর বাবাই তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার প্রত্যয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, যেন নিজে যেভাবে চান সেভাবে বড় হতে পারেন। শাম্মীও ধরে নিয়েছিলেন– এটিই স্বাভাবিক; কিন্তু আদতে মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব কম মেয়ের পক্ষেই এমন স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব ছিল তখন। 
মাধ্যমিকে থাকতেই স্কলারশিপের আবেদন
মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই শাম্মী স্যাট ওয়ান ও টু পরীক্ষা দেন এবং আমেরিকার ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন স্কলারশিপের জন্য। কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন না, তাঁকে কেউ স্কলারশিপ বা আর্থিক সহায়তা দেবে কিনা সে দেশে পড়ার জন্য। কিন্তু শাম্মী বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। এরপর এমআইটিতে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন ডায়াল-আপ ইন্টারনেটের সাহায্যে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে অনেক সময় লাগত। এমআইটির একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট হওয়া তাঁর জীবনকে সব দিক থেকেই বদলে দিয়েছে– এমনটাই বিশ্বাস শাম্মীর। শাম্মীর কথায়, ‘সবাই এমআইটির কড়া ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা কার্যক্রমের কথা জানে, কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়েও অসাধারণ জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেয়েছি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আমার যে প্যাশন ছিল, তা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় বার্ষিকে এসে একটা লিডারশিপ প্রোগ্রামের সহপ্রতিষ্ঠাতা হলাম, যা পরে বিওয়াইএলসিতে রূপান্তরিত হয়। এটির জন্যও প্রথম অনুমোদন আসে এমআইটি থেকে। মনে পড়ে এখনও, শীতকালীন ছুটির সময় যখন সবাই চলে গিয়েছিল ছুটি কাটাতে, আমি তখন জনশূন্য স্টুডেন্ট সেন্টারে একা বসে আমার প্রপোজালের ড্রাফট বানাচ্ছিলাম। বিওয়াইএলসির যাত্রা শুরু করাটা আমাকে একদম গোড়া থেকে যে কোনো কাজের অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’
গ্র্যাজুয়েশন, গুগল ও তাঁর কাজ
স্ট্যানফোর্ড জিএসবি ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল থেকে এমবিএ এবং এমপেইড (মাস্টার ইন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) এই দুটি ডিগ্রি নেন শাম্মী। ডিগ্রি নেওয়ার পর গুগলে যোগ দেন, সেখানে বর্তমানে গুগলের পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম টিমের পণ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর দল গুগলের সব নগদীকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে। আপনি গুগলকে অর্থ দিলে বা গুগল কাউকে দিলে, সেসব তাঁর দলের হাত দিয়ে যায়। কোটি কোটি মানুষ যে ইউটিউব, ম্যাপস, অ্যাডওয়ার্ডস, প্লে ইত্যাদি গুগল পণ্য ব্যবহার করে, সেসব নিয়েই শাম্মীর দলের কাজ। তাঁর কাছে স্টার্টআপে কয়েকশ ব্যবহারকারীর জন্য কাজ থেকে শুরু করে গুগলের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর জন্য কাজ করাটা এক শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি!  
আরও পরিষ্কার করে বললে, গুগলে পণ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর কাজ হলো, একটি পণ্য ‘কী’, তা সংজ্ঞায়িত করা। তা ছাড়া ব্যবহারকারীর চাহিদা, প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা, নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ, রাজস্ব প্রভাব, গুগলের লক্ষ্য ইত্যাদি বুঝে কাজ করতে হয় তাঁকে। মূলত শাম্মীর পরামর্শ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং দল প্রযুক্তিগত বাস্তবায়নের নকশা করে। তিনি তাঁর কাজটি উপভোগ করেন, যেহেতু এখানে একেবারে সবকিছুর মধ্যে থেকে পরিচালনা করতে হয় এবং নিজের মতামত দেওয়ার স্বাধীনতা আছে। 
পেশাগত জীবনের শুরুতে
পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি এমআইটি থেকে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। তবে সেই কাজটি তেমন উপভোগ করেননি, কারণ তাঁর আকর্ষণ ছিল উন্নয়ন খাতে কাজ করার দিকে। তাই ২০১১ সালে ওয়াটারহেলথ ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ টিমের হয়ে কাজ করেন। চট্টগ্রামে পানির সুবিধা নিয়ে কাজ করেছিলেন তখন। তারপর ‘জিওন’-এ তাদের প্রথম টেলিমেডিসিন পণ্য আনতে সাহায্য করার মাধ্যমে বুঝতে পারেন, কোনো কিছু শুরু করা খুব কঠিন না হলেও নির্দিষ্ট অঞ্চল ঠিক করে যোগ্য নেতা হিসেবে কাজ করা পুরোপুরি আলাদা বিষয়। ফলে তিনি আমেরিকায় গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।
থিংকিং ফাস্ট থিংকিং স্লো 
তিনি ‘থিংকিং ফাস্ট থিংকিং স্লো’ বইটি পড়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়ায় কী কী ভুল আছে এবং কীভাবে তা শোধরানো যায়, বুঝতে হলে এই বই অতিজরুরি। আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে এ বই আমাকে অসম্ভব সাহায্য করেছে।
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন, ‘আমি পণ্য ব্যবস্থাপনা ও ফিনটেক স্পেস নিয়ে বেশ উদ্বুদ্ধ। ভবিষ্যতে এ খাতে পণ্য তৈরি করার স্বপ্ন দেখি।’ তবে ভুলে যাননি দেশের কথাও। তাই তো বলেন, ‘গুগলে ছয় বছর কেটে গেলেও সময়টি উপভোগ করছি। দেশে কোনো টেক প্রতিষ্ঠানে সুযোগ থাকলে অবশ্যই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই।’ আমরাও চাই, তাঁর হাত ধরে এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ!

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×