ঢাকা মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ও হ্যারিসনের একদিন

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ও হ্যারিসনের একদিন

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান ছবি : অনলাইন

ফাহমিদা রিমা

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১১

জর্জ হ্যারিসন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আয়োজক। যুক্তরাষ্ট্রের ‘শিকাগো নাও’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই আয়োজনের নেপথ্য ঘটনা তুলে এনেছেন ফাহমিদা রিমা

হ্যারিসনের জন্য অনেক বড় একটি দিন ছিল ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। এ দিনেই আয়োজিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। আইডিয়াটা তাঁর মাথায় এসেছিল ১৯৭১-এর শুরুর দিকেই। একদিন তিনি রবি শংকরের সঙ্গে নৈশভোজ সারছিলেন। রবিই তাঁর কাছে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেন। এরপর থেকে হ্যারিসনকে নিয়মিতই দেশটির খোঁজ-খবর জানাতে থাকেন রবি শংকর। সে বছরের বসন্তকালে, পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছে, তখন এ ব্যাপারে কথা বলতে আরও একবার হ্যারিসনের সামনে হাজির হন রবি। হ্যারিসন সেই আহ্বানে সাড়া দিতেই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে সাড়া পড়ে যায়। তারপর তো মিউজিক ও মানবতার ইতিহাসে তাঁর নামটি পৌঁছে যায় অনন্য উচ্চতায়।
নেপথ্য ভূমিকায় যে সম্পর্ক
‘বিটলস’ ব্যান্ডটি ভেঙে যাওয়ার পর, সেটির পরিচয় থেকে বেরিয়ে, একক ক্যারিয়ারেই মন দিয়েছিলেন হ্যারিসন। তাঁর একক রেকর্ড ‘অল থিংস মাস্ট পাস’ ব্যাপক সাফল্য পায়। অনেকের মতে, এটি যেকোনো বিটলস সদস্যের শ্রেষ্ঠতম সলো অ্যালবাম। ‘ডিলেনি অ্যান্ড বনি’তে বেশ কয়েকটি লাইভ শোতেও পারফর্ম করেন তিনি। তাতে করে লিয়ন রাসেল, জিম কেল্টনার, ডন প্রিস্টন ও জিম হর্নের মতো মিউজিশিয়ানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর। এ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য তাঁর আয়োজন করা কনসার্টটিকে সফলে নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। 
যাদের নিয়ে আয়োজন
বর্তমানে এমন একটি কনসার্টের আয়োজন করা তেমন কঠিন বিষয় না হলেও, ১৯৭১ সালে তা ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জের। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন– ভেন্যুটা সহজেই পাওয়া গেছে। তবে মিউজিশিয়ান পাওয়া অত সহজ ছিল না। হ্যারিসন ও তাঁর তখনকার স্ত্রী প্যাটি বয়েড মিলে তৈরি করেছিলেন সেই কনসার্টের মিউজিশিয়ানের তালিকা। রিঙ্গো স্টারকে খুব সহজেই রাজি করাতে পেরেছিলেন তারা। জিন কেল্টনার, ক্লজ ভুরমান ও বিলি প্রিস্টন যোগ দিলেন। তাদের ক্যারিয়ারের জন্য সেটি ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক রাত। এরিক ক্ল্যাপটন, লিয়ন রাসেল, পল ম্যাকার্টনি ও জন লেননকেও নিমন্ত্রণ জানালেন তারা। রাসেল চাইলেন নিজের ব্যান্ডটিকেও হাজির করতে। তবে শুরু থেকেই হাজির হওয়ার ব্যাপারে অনীহা ছিল পল ম্যাকার্টনির। এটিকে ‘বিটলস’-এর একটি পুনর্মিলনী হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন তিনি; আর সেটির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবে জন লেনন বেশ আগ্রহ দেখালেন। কনসার্টটির দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত এতে পারফর্ম করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেন। কিন্তু এতে জনের স্ত্রী ইয়োকোকে নিমন্ত্রণ না করায়, এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জের ধরে শেষ পর্যন্ত তিনি হাজির হননি। অন্যদিকে ক্ল্যাপটনের ঘটনা ছিল ভিন্ন। তিনি তখন হেরোইন আসক্তিতে বুঁদ। ফলে তিনি পারফর্ম করবেন কিনা, সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত হতে পারছিল না। তাঁর স্থানে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঠিক করে রাখা হলো জেস এড ডেভিসকে। শেষ পর্যন্ত ক্ল্যাপটন অবশ্য পারফর্ম করেছিলেন। 
যে জন্য চাইলেন হ্যারিসনকে
আর ছিলেন বব ডিলান। অন্য যে কারও চেয়ে, ববের উপস্থিতিই মনেপ্রাণে বেশি চাইছিলেন হ্যারিসন। মিউজিকের এ ঐতিহাসিক কনসার্টে ববের উপস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিলেন তিনি। প্রস্তাব পেয়ে ববের মাথা থেকে একটা আইডিয়া এলো। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য করতে চাইলেন তিনি। কিন্তু ভয় ছিল তাঁর একটাই, মঞ্চভীতি! এর আগে, কয়েক বছর ধরে, দর্শকদের সামনে সরাসরি পারফর্ম করেননি তিনি। কোনো ব্যান্ডের ফ্রন্টম্যান হিসেবে কখনোই পারফর্ম করার অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর। বিটলসের সর্বশেষ কনসার্টটিও হয়ে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে। ফলে ববকে সাহস জোগালেন হ্যারিসন; বললেন, আমি যদি পারি, তুমিও পারবে। তবে কনসার্টটি শুরু হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউই নিশ্চিত ছিলেন না, বব আদৌ পারফর্ম করবেন কিনা। শেষ পর্যন্ত তিনি তা করেছিলেন, আর সেটি তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে 
অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলোর একটি হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে প্রযুক্তি এত সহজলভ্য ছিল না। এখনকার মতো চাইলেই বহু ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন সেট করে দিয়ে সেগুলোকে সহজে সমন্বয় করা সম্ভব ছিল না। ফিল্মের প্রতিটি ফ্রেমে মিউজিককে নিখুঁতভাবে ধারণ করে রাখতে খেটে মরতে হয়েছে একেকজন এডিটরকে। তবে হ্যারিসনের নিরলস প্রচেষ্টায়, সব মিলিয়ে কনসার্টটি হয়ে উঠেছিল অনন্য সাধারণ। 

আরও পড়ুন

×