ঢাকা শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫

দেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টা

দেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টা

ফাইল ছবি

শরীফ উদ্দিন সবুজ

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৩

মনন রেজা নীড়। দাবায় সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার সে। এই কৃতিত্ব অর্জনে তাকে ভাঙতে হয়েছে দেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদের রেকর্ড। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে তৃতীয় নর্ম পেয়ে এ কৃতিত্ব অর্জন করেছে মনন। গত বছর হয়েছিল জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। নিজের এ অর্জন ও আগামীর স্বপ্নের কথা বলেছে সাহস-এর কাছে।  শুনেছেন শরীফ উদ্দিন সবুজ

মনন রেজা নীড়দের ছোট্ট নীড়ের দরজা গলিয়ে ভেতরে পা রাখতেই চোখ চলে যায় কম্পিউটারের টেবিলে। দেখি, মনন খেলছে কম্পিউটারে। তার শোবার ঘরটির ওয়ার্ডরবের ওপর থরে থরে সাজানো রাজ্যের পুরস্কার। পাশেই আরেকটি বড় শো-কেস। তাও ভরা পুরস্কারে। মননের মা আমার কৌতূহলী চোখ দেখে বলেন, ‘এটি মননের পুরস্কারেরই শো-কেস। এ শো-কেসে না ধরায় কিছু পুরস্কার রাখা হয়েছে 
ওয়ার্ডরবের ওপরে।’ ক্লাস নাইনে পড়ে নীড়। এ বয়সেই আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছে সে। দেশের জন্য বয়ে এনেছে গৌরব। ওর মতো ছোট বয়সে আর কেউ এ দেশে আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়নি। বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বয়সে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন–ফিদে আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার রেকর্ডটি এতদিন ছিল নিয়াজ মোরশেদের। তিনি পনেরো বছর পাঁচ মাসে আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছিলেন। নীড় নিয়াজ মোরশেদের রেকর্ড ভেঙে ১৪ বছর ৪ মাসে এটি অর্জন করে। 
একটু পেছনে ফিরে…
নীড়ের মাকে ছেলের শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিয়ে জানতে চাই, শৈশব কেমন ছিল ছেলের? উত্তরে মা মৌমন রেজা শ্রাবণী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই নীড় ছিল অন্য শিশুদের চাইতে একটু বেশি মেধাবী। তাই আড়াই বছর বয়সেই স্কুলে নিয়েছিলাম ভর্তি করতে। স্কুল ওকে নেয়নি। পরে সাড়ে তিন বছর বয়সে নারায়ণগঞ্জের ডন চেম্বারের ফিলোসোফিয়া স্কুলে ভর্তি করাই। সেখানে সে আঁকাআঁকি করত। গঙ্গা ফরিঙে গান গাইত, কবিতা আবৃত্তি করত। ওর বাবা নাজিম রেজা দাবা খেলতেন। মূলত দাবার প্রতি আগ্রহ তৈরি সেখান থেকেই। ২০১৭ সালে সাত বছর বয়সে নাহার চেস একাডেমির কোচ নাজমুল হাসান রুমি ওকে অন্যদের সঙ্গে ৪ থেকে ৫ মাস প্রশিক্ষণ করায়। এই প্রশিক্ষণের পর মনন যেকোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়ের মধ্যে থাকত। রুমি স্যার ওকে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতেন। বিখ্যাতদের কাছ থেকে ছেলে পুরস্কার নিত। এসব ওকে খুব উৎসাহিত করে। ২০১৭ সালে কমনওয়েলথ গেমসে গিয়ে রৌপ্যপদক পায় নীড়। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক আসরে আরও বড় কিছু করার ইচ্ছা তৈরি হয়। এর আগে একই বছর দুটি জেম টুর্নামেন্ট খেলে ভারতের উড়িষ্যায়। এরপর সে আন্ডার এইট ও টেনে শ্রীলঙ্কা গিয়ে দুটি গোল্ড, একটা সিলভার; থাইল্যান্ডে একটি সিলভার, উজবেকিস্তানে একটি গোল্ড, পরে আবার শ্রীলঙ্কায় গিয়ে দুটি সিলভার মেডেল পায়। ওর রেটিং বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় দুটি গোল্ড পাওয়াতে ক্যান্ডিডেট মাস্টার হয়ে যায়। ২০১৯ সালে নীড় মাত্র ৯ বছর বয়সে জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এ বয়সে আগে কেউ কোনোদিন জাতীয় দাবায় অংশ নেয়নি। তখনই ওকে নিয়ে লেখালেখি হয় সর্বকনিষ্ঠ হয়েও নীড় বড়দের সঙ্গে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে জাতীয় দাবায় অংশ নিচ্ছে। ২০১৯ থেকে কভিডের দুই বছরের গ্যাপে মননের অগ্রগতি অনেক পিছিয়ে গেলো। তারপর ২০২১ সাল থেকে আবার খেলা শুরু করল। ২০২২ সালে ২৩শ রেটিং করে ফিদে মাস্টার অর্জন করে সে।’
ছেলের শৈশব জানতে চাওয়ায় মা যা বললেন তার পুরোটাই যেন দাবাকেন্দ্রিক। এমন ছেলে দাবার মাস্টার হওয়ারই তো কথা! 
যাদের ছায়ায়
দাবায় নীড়ের আগ্রহ বাবাকে দেখে। তবে তার কোনো গৃহ শিক্ষক ছিলেন না? এই প্রশ্ন মননের মাকে করলেও মায়ের মুখ থেকে উত্তর টেনে নিয়ে মনন বলে, ‘নাজমুল হাসান রুমি স্যার, সাজু স্যার, প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান স্যার, আইএম শাকিল স্যার, জিএম রাকিবুল স্যার, জিএম রাজিব স্যার তারা সবাই আমার শিক্ষক। ফেডারেশনের মাধ্যমে বা স্কুলে কমবেশি তারা সবাই আমাকে শিখিয়েছেন। সর্বশেষ কলকাতার জিএম নিলোৎপল স্যারের কাছ থেকেও আমি শিখেছি।’
তবু আক্ষেপ!
এত সাফল্যের পরও মনন রেজা নীড় আক্ষেপ করে বলে, ‘আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার পর আমি আশা করেছিলাম অ্যাটলিস্ট কিছু পাব সরকার থেকে। কিন্তু সরকার থেকে আমাকে একটা ফুলও দেয়নি। ফেডারেশন থেকেও কিছু পাইনি। হয়তো তারা আমার সম্পর্কে জানেই না। এ ধরনের বিষয় তো যেকোনো মেধাবীকে নিরুৎসাহিত করে। দাবা খেলায় ট্রেনিংয়ের প্রয়োজনীয়তাবোধ আমাদের দেশের অনেকে অনুভব করে না। ফুটবল, ক্রিকেটে কোনো দল যদি বিদেশে যায় সেক্ষেত্রে দলের সঙ্গে কোচ, ম্যানেজার যায়। তেমনি দাবার দল বিদেশে যাওয়ার সময় সঙ্গে অন্তত একজন জিএম থাকা দরকার। যথাযথ পরিচর্যা হলে আমাদের দেশের দাবা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’ 
ছেলের এমন সাফল্যে আক্ষেপ বাড়ে মায়েরও। নীড়ের মা মৌমন রেজা শ্রাবণী বলেন, ‘ওর আন্তর্জাতিক ট্রেইনার প্রয়োজন। আমি যদি ভারতীয় কোনো ট্রেইনার দিয়ে ওকে অন্তত ছয় মাস ট্রেনিং দিতে পারি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও হতে পারবে কিনা জানি না, এটি আল্লাহর হাতে, তবে ওকে ওই ধাপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারব। এ ক্ষেত্রে মূল বাধা হচ্ছে টাকা।’
স্বপ্ন এবার বিশ্বজয়ের, তবে…
দেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টারের কাছে তার আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে বলে, ‘আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার আগেও সমকালকে বলেছিলাম দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চাই। এখন মাস্টার হয়েও বলছি, দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চাই আগামীতে। তবে এই ক্ষেত্রে বড় বাধা আর্থিক সমস্যা। জানেন, এই তো কিছুদিন আগে মাত্র আঠারো বছর বয়সে ভারতের দাবাড়ু গুকেশ ডোমরাজু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যদিও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া এখনও আমার জন্য অনেক দূরের পথ, তারপরেও আমি স্বপ্ন দেখি। কেউ যদি আমাকে ৫ থেকে ১০ বছরের একটা স্থায়ী স্পন্সরশিপ দেয় তাহলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরিকল্পনায় এগিয়ে যেতে পারব। আসলে খেলতে গিয়ে যদি মাথায় এই চিন্তা নিয়ে ঘুরি যে পরের খেলা খেলতে যাওয়ার খরচ কোত্থেকে জোগাড় হবে তাহলে ভালো খেলা কীভাবে খেলব বলেন?’ 
নীড়ের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন বারবার এসে সামনে ঘুরে যাচ্ছিল ওর ছোট ভাই মাদল রেজা নব। তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র। কিছুদিন পরেই শুরু হবে তার চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস। তার কাছেও জানতে চাইলাম মনন সম্পর্কে। সে বলে, ‘আমার ভাইয়া খুব মেধাবী। তাকে নিয়ে আমি স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করি। আমি বিশ্বাস করি, একদিন আমার ভাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে।’ 
একই বিশ্বাস দেখলাম নীড়ের মা আর নীড়ের চোখেও। সেই বিশ্বাস আমরাও করি; একদিন এই তরুণই বিশ্বদাবায় উড়াবে লাল-সবুজের পতাকা! 

আরও পড়ুন

×