হামজা যেভাবে লাল সবুজের
হামজা দেওয়ান চৌধুরী
ইমাম হোসেন মানিক
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২১:৫৪ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ১০:৫৪
হামজা দেওয়ান চৌধুরী। বাংলাদেশ ফুটবলের আলোচিত পোস্টার বয়। প্রিমিয়ার লিগে লেস্টার সিটির হয়ে খেলা হামজা ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলেও ছিলেন। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী মার্চে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাঠে নামবেন এই তরুণ তুর্কি। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ইমাম হোসেন মানিক।
গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য ফিফার অনুমতি পেয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লেস্টার সিটির খেলোয়াড় হামজা দেওয়ান চৌধুরী। এতেই অবসান হয়েছে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা। ২০২৪ সালের জুনে হামজা বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। আগস্টে মা রাফিয়া চৌধুরী লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে হামজার বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। এরপর হামজা তাঁর ক্লাব এবং ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অনুমতি চান। তাদের অনুমতির পর ফিফার চূড়ান্ত অনুমোদন আসে। লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়ানোর আগেই দেশের মানুষের কাছ থেকে এত ভালোবাসা তাঁর আগে অন্য কোনো খেলোয়াড় পাননি! এই নিবিড় ভালোবাসা হামজাকেও ছুঁয়ে গেছে। তাই তো তিনি বলেন, ‘শেষ ধাপ সম্পন্ন হয়েছে, এবার বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে আছি।’ সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৫ মার্চ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে তাঁর অভিষেকের অপেক্ষায় বাংলাদেশ।
লেস্টার সিটি থেকে লাল-সবুজে
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা একমাত্র ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা চৌধুরী লেস্টার সিটির হয়ে খেলছেন। ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত ক্লাবটির সঙ্গে তাঁর চুক্তি রয়েছে। এর আগে ধারে খেলেছিলেন ওয়াটফোর্ডে। রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছিলেন ২০২২ সালের অক্টোবরে স্কাই স্পোর্টসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। সেটি বাস্তবায়ন হতে প্রায় দুই বছর লেগে গেল। দলে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার অবসান হচ্ছে না। লেস্টারের হয়ে এখন পর্যন্ত দুটি শিরোপা জিতেছেন হামজা। ২০২১ সালে জিতেছেন ইংলিশ এফএ কাপ এবং ২০২২ সালে ইংলিশ সুপার কাপ।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দামি দল বাংলাদেশ
হামজা আসায় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দামি দলের কাতারে উঠে এসেছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ! বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে হামজার অভিষেক আগামী মার্চে ভারতের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে খেলার আগেই বাংলাদেশ দলে হামজার যুক্ততায় আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দামি দলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ফুটবল বিশ্ব পরিচালিত হয় মূলত ক্লাবগুলোকে কেন্দ্র করে। ফুটবলারদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্লাবগুলোর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়। প্রতিবছর দল বদলে বিভিন্ন দামে ফুটবলারদের নিজেদের দলে ভেড়ায় কিংবা ছেড়ে দেয় ক্লাবগুলো। কোন ফুটবলারের বাজারমূল্য বর্তমানে কেমন তা বিভিন্ন মানদণ্ডে যাচাই করে ট্রান্সফারমার্কেট নামে ক্রীড়া ওয়েবসাইটটি। তাদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সব খেলোয়াড়ের বাজারমূল্য ৩.০৫ মিলিয়ন ইউরো। অন্যদিকে হামজার একারই বাজারমূল্য ৪.৫০ মিলিয়ন ইউরো। অর্থাৎ ১.৪৫ মিলিয়নের বেশি। ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ১০ মিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছিল হামজার বাজারমূল্য।
বাংলাদেশ জাতীয় দলে হামজা যোগ দেওয়ায় মোট বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৭.৫৫ মিলিয়ন ইউরো, যা এখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দুইয়ে থাকা ভারতের বাজারমূল্য ৫.৮৬ মিলিয়ন ইউরো। এরপর রয়েছে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তান। এ ছাড়া পুরো এশিয়াতে বাজারমূল্যের দিক থেকে ১৯ নম্বরে বাংলাদেশ। এ তালিকায় বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে উত্তর কোরিয়ার মতো দেশকে। ২৮৭ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে এশিয়ার মধ্যে বাজারমূল্যে শীর্ষে রয়েছে জাপান। এর পরের অবস্থান ১৫৯.১৫ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার।
শৈশব ও ফুটবল ক্যারিয়ার
হামজা চৌধুরীর মা বাংলাদেশি, বাবা গ্রানাডিয়ান। হামজা তাঁর উঠে আসার পেছনে মা রাফিয়া, সৎবাবা মুরশিদ এবং চাচা ফারুকের ত্যাগের কথা স্বীকার করেন। হামজার ছোটবেলার বড় অংশ জুড়ে তাঁর মা রাফিয়া, যাঁর পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের দেওয়ান বাড়ি। নিজের ক্যারিয়ার ও শৈশব নিয়ে হামজা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শৈশবে মা একদিন আমাকে লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যান, সেখানে ফুটবলের একটা আয়োজন ছিল। মূলত সেখানেই ছিল আমার ফুটবলের শুরু। আমার মা নতুন ও ভিন্ন মতামতের প্রতি উদার। সেদিন আমি প্রথম খেলতে যাওয়ার পর মা সিদ্ধান্ত নেন খেলা চালিয়ে যাওয়ার। ছোটবেলায় নিয়মিত হবিগঞ্জে আসতাম। এলে দুই বা তিন সপ্তাহ থাকা হতো। সেখানে যা খুশি তা করতে পারতাম। রাত ১০টায় ছোট ছোট শিশু ঘুরে বেড়াত। আমি বাংলা বলতে পারি, এটি জেনে মানুষ বেশ অবাক হতো।
আমার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আমি অবগত। এটি আমাকে আরও বিনয়ী করে তোলে। আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। স্কুল ছাড়াও ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে পড়ালেখা করেছি। আমি ও আমার ছোট বোন মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার কোরআন শরিফ পড়তাম। ড্রেসিংরুম থেকে বের হওয়ার সময় আয়াত-উল-কুরসি পড়ি। আমি আরও ছোট ছোট দোয়া পড়ি, যা মা আমাকে শিখিয়েছেন। মা অনেক শক্তিশালী একজন নারী, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতি সামলাতে হয়।’
শেখার আছে অনেক কিছু
হামজা বাংলাদেশে খেলার অনুমতি পেয়েছেন লেস্টার সিটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এমন একটি পোস্ট দেওয়ার পর সেটি দ্রুততম সময়েই ৫০ হাজারের বেশি শেয়ার হয়ে আলোচনায় উঠে আসে। এতে বোঝা যায়, কেবল মাঠে নয়; মাঠের বাইরেও বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে আসছেন হামজা। তিনি যে মানের খেলোয়াড় এবং যে লেভেলে খেলতে আসছেন, তাঁর কাছাকাছি মানেরও কেউ নেই বাংলাদেশে। ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলেও খেলেছেন হামজা। ইংল্যান্ডের এফএ কাপ, চ্যাম্পিয়নশিপ এবং সুপার কাপ জয়ী এ ফুটবলারের অভিজ্ঞতা থেকে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৮৫-তে থাকা বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
- বিষয় :
- ফুটবল