আশায় বসতি
ইরাজ আহমেদ
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৩:০৩ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৩:১৮
মানুষ আশায় বাঁচে। একা এবং একসঙ্গে সেই মানুষই আবার আশা জাগায়। আঠারো কোটি মানুষ বসবাস করে আমাদের এই বাংলাদেশে। কত ধরন, কত বর্ণ আর বিচিত্র ভাবনায় আচ্ছন্ন মানুষ মিলে এখানে একটি সমাজ গড়ে তুলেছে। সেই সমাজে স্বার্থপর মানুষ আছে, ন্যায়-অন্যায় বোধের বাইরের মানুষ আছে, ভালোবাসতে পারা মানুষ আছে, শান্ত মানুষ আছে, অশান্ত মানুষও আছে। নানান সুরের সমন্বয়েই একটা সমাজ গড়ে ওঠে।
আবার সেই সমাজে শ্রেণি বিভাজনের রেখা কিছু মানুষকে আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানের বিচারে পৃথক করে দেয়। সমাজে বিভাজনের কাটাকুটি খেলার বয়স অনেক। বিভাজন যারা করে তাদের চরিত্র পাল্টায়, অবস্থান পাল্টায় কিন্তু বিভাজনের বাইরে থেকে যাওয়া যে সাধারণ জনগোষ্ঠী তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারাই সাধারণ মানুষ। আমার ভাবনায় বাংলাদেশে সেই সাধারণ মানুষই আশা জাগিয়ে রাখে।
সাধারণ মানুষের প্রধান প্রবণতা কী? মানুষ কী চায়? যদি বলি, সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে ঝাঁকের কৈ হতে চায়। আর দশজন যা করছে একজন ব্যক্তিমানুষ সাধারণভাবে সেই প্রবণতায় গা ভাসিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই প্রবণতার অন্য নাম গড্ডলিকা প্রবাহ। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন এমন চরণ, ‘‘খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি, ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি’’। সাধারণ মানুষের জীবন প্রবাহের নিখুঁত ছবি পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। একটি কথা তো সত্যি, জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ তো কখনোই অসাধারণ সৃষ্টির ঢেউ তৈরি করে না। কিন্তু তারা নির্ধারণ করে একটি সমাজের ভবিষ্যতের গতিপথ। এ কথায় হয়তো বিতর্ক তৈরি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের দূর এবং নিকট ইতিহাসের প্রবাহের দিকে তাকিয়ে আমার এমনটাই মনে হয়েছে।
সব সমাজেই মানুষের শ্রেণিতে বিভক্তি আছে। এই বিভেদ চিন্তার মধ্যেও আছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তি আছে, সামাজিক বিভক্তি আছে, সাংস্কৃতিক চেতনায় বিভক্তি আছে, ধর্ম এবং ধর্মীয় চেতনায়ও বিভক্তি আছে। একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে আমাদের শিশু, কিশোর অথবা তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘আমি কী চাই’ প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কয়েক দশক ধরে তাদের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া, মানস-গঠন এই সমাজের প্রচলিত চিন্তার সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে অনেকে অভিযোগ করেন। নতুন চিন্তার সঙ্গে পুরোনো চিন্তার ফারাক থাকবেই। কিন্তু একটু পিছিয়ে গিয়ে যদি দেখি, এ দেশে ষাট কিংবা সত্তরের দশকের সমাজে মানুষের মধ্যে কি এই চিন্তার সংঘাত ছিল না? একটি সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন আরেকটি সংস্কৃতির বৈপরীত্য কি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি? তবুও এ ধরনের বিভাজন রেখার কথা মাথায় রেখে ১৯৭১ সালে মানুষ এক জায়গায় হয়েছিল একটি দাবিতে। সেই দাবির নাম স্বাধীনতা। রাজনৈতিক মত ও পথের অমিল ছিল তখনও। কিন্তু তবুও মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেই লড়াইয়ে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার সামান্য বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা বলে, এ দেশের মানুষ একটা সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আঘাতে, বিপর্যয়ের মুখে তারা বারবারই ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়।
দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে মাঠেঘাটে, মানুষের মধ্যে কাজ করতে গিয়েও এই ছবি দেখেছি। ১৯৮৮ সালের দীর্ঘ এবং ভয়াবহ বন্যার আগ্রাসন স্তিমিত হয়ে আসার পর মানুষ কীভাবে নিজেদের জীবনকে আবার সংগঠিত করছে তা দেখা এবং রিপোর্ট করার জন্য একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে আমাকে পাঠানো হয়। তখন বাংলাদেশের বহু গ্রাম বন্যার দীর্ঘস্থায়ী বৈরী আবর্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তাও তেমনভাবে পৌঁছায়নি। কিন্তু তখন বাংলাদেশের কৃষকদের বসে থাকতে দেখিনি কোথাও। তারা মাঠে নেমে পড়েছেন কাজ করতে। অনেকের মুখেই শুনেছি, ‘কাম না করলে মাইনষের ভাত জুটব কেমনে!’ এই কথাটা। তাদের কেউ এসে বলে দেয়নি কী করতে হবে। কিন্তু তারা সঠিক কাজটি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। অত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে জীবনকে তার স্বাভাবিক গতিপথে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন তারা। হেমিংওয়ের উপন্যাসের সেই বিখ্যাত লাইন তখন বারবার ভাবনায় এসেছে– ‘‘মানুষকে পুরোপুরি কখনোই ধ্বংস করা যায় না।” সেই অজেয় মানুষের ছবি আমার কাছে বরাবরই ভিন্ন এক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। যখন মনে হয়েছে আর কোনো আশা নেই, তখন এ দেশের সাধারণ মানুষই আশার পাখিকে ডেকে এনেছে।
আশির দশকের প্রায় পুরো সময়টা জুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ করা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা করেছিল এ দেশের ছাত্রসমাজ। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয় সেই আন্দোলন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে সেই আন্দোলন। নির্যাতন, প্রতিবাদ আর সংঘাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা রাজনীতি কখনও মুখ থুবড়েও পড়েছে। সাধারণ মানুষ তখনও দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকের অবস্থানে স্থির। হতাশা ঘিরে ধরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাবতে বাধ্য করত, সব আয়োজন তাহলে ব্যর্থ। তখনও সেই হতাশার প্রহরে অবাক হয়ে দেখেছি স্বৈরাচার হটানোর যৌক্তিক দাবির সঙ্গে ধীরে ধীরে মানুষ কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে।
একটানা হরতাল, অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের সমর্থন সরব হয়েছে। খেটে খাওয়া মজুর, ছোট দোকানি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবাই সেই আন্দোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। সেই জনসমর্থন সফলতাও পেয়েছে নব্বইয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, রাজনৈতিক বিভেদ, অর্থনৈতিক শ্রেণি বিভক্ততা, সামাজিক দূরত্ব পেরিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ বড় ধরনের প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক সংকটে একটি বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথার ওপর ক্রান্তীয় সূর্য, পায়ের তলায় নরম পলিমাটি। যে মানুষটি ফসল ফলায় অথবা শিল্পকারখানায় কাজ করে, যে দিনভর রাজপথে রিকশা টানে অথবা অফিসে ফরম দেয়, তাদের প্রত্যেকেরই স্বপ্ন আছে। কী সেই স্বপ্ন? স্বপ্ন দিনশেষে স্বজনদের জন্য অন্ন জোটানো, রাতে নিজের ঘরে শান্তির নিদ্রা। আমি হয়তো খুব সহজ ভাষায় কথাটা লিখে ফেললাম। জীবনের হিসাব, বেঁচে থাকার পথগুলো হয়তো এ রকম সরলরেখা ধরে চলে না। সেখানে নানান কৌশল আছে, টিকে থাকার জন্য ধান্দাবাজি আছে। তবু দিনশেষে মানুষ ভাতের স্বপ্নই তো পল্লবিত করতে চায় জীবনে। যখন তাদের সেই বাড়া ভাতে কেউ ছাই ঢালতে চায় তখনই তারা প্রতিবাদ করে। বাংলাদেশের মানুষ চিরকালই আমার কাছে আশাবাদের কেন্দ্র। আমাদের দেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি।
মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশে মানুষের চাপ দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কোনো এক রাতে দীর্ঘ বিমান যাত্রায় একাকী ভ্রমণ করা সেই সহযাত্রী নারীটির সঙ্গে কথা বলে মনে হয়নি জনসংখ্যার চাপ, দেশের অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা তাকে কোথাও দমাতে পেরেছে। চার সন্তানের জননী মধ্য বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের বিমানবন্দরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। গ্রামে ঘর তুলেছেন শ্রমের অর্থে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনিও গ্রামের মহিলাদের সেলাই শেখানোর জন্য ছোট্ট একটা পাঠশালা খোলার স্বপ্ন দেখেন। দেশে ফিরে নিজের আয় থেকে জমানো অর্থেও খানিকটা ব্যয় করে একটা সেলাই মেশিন কিনবেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন।
জানি না তার স্বপ্ন সফল হয়েছে কিনা। কিন্তু স্বপ্ন যে দেখেছেন তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। সেই স্বপ্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। অনেকের আরও বিত্তবান হওয়া, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা বা মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করার বিপরীতে সেই স্বপ্ন আমার কাছে ভীষণ উজ্জ্বল, ভীষণ সুন্দর। মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মতো করে ভেবে, নিজেদের কাজটা করে বড় কোনো আলোকবৃত্তের বাইরে থেকেও জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষের স্বপ্ন কখনও ব্যর্থ হয় না। সে কখনও পরাস্ত হয়, ভেঙে পড়ে, প্রতারিত হয় ভুল রাজনীতির চক্রের কারসাজিতে। কিন্তু আবার সেই পরাস্ত মানুষ অজেয় জীবন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আশার সন্ধান করে অন্যদের জীবনে।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- ইরাজ আহমেদ
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-২০২৩