- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
- সুন্দর হোক আগামী
সুন্দর হোক আগামী

সৌন্দর্যচর্চার ইতিহাস দীর্ঘ। সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সৌন্দর্যপিপাসু। এ শুধু বহিরাঙ্গের চাকচিক্য নয়, অন্তরঙ্গের প্রকাশও। প্রতিটি ভাষার কাব্যে নানা উপমায় উজ্জ্বল হয়েছে অঙ্গসৌষ্ঠবের অপরূপ বর্ণনা। মনের গভীরে যে ভাবনার উদয়, যে উপমার উদগীরণ, তা শুধু দৈহিক নয়; মনোদৈহিক। দর্শনধারী এ চর্চায় ফুটে ওঠে ব্যক্তিত্ব। আর যারা নান্দনিক ভাবনায় মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেন, তারা রূপকারিগর। এই রূপকারিগরদের সৌন্দর্যচর্চা এখন রূপ নিয়েছে শিল্পে।
এদেশে সৌন্দর্যচর্চা শুরু হয় চায়নিজদের হাত ধরে। নারীদের ভালো লাগার বিষয়টির দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন জেরিন আজগর। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই শিল্প ভীষণ নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। এই সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছে দেশের রূপকাররিগররা; যা এতটা সহজ ছিল না। শুরুর দিকে কেউই এটাকে পেশা হিসেবে দেখেনটি। কারণ এই পেশাকে আমাদের দেশে খুব ভালো চোখে দেখা হতো না। যারা করেছেন খুব শখের বসে। আবার অনেকেই এসেছেন খুব ভালোবেসে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সুদূরপ্রসারি ভাবনার ফলে আজ বড় একটি জায়গা নিয়েছে বিউটি ইন্ডাস্ট্রি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন শিল্পে রূপান্তর। গত বছর কভিডের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার বিউটিকে ইন্ডাস্ট্রি ঘোষণা দিয়েছে।
এই অর্জনের পেছনে দুই ধরনের কারিগর কাজ করেছে। এক. যারা খুব ভালোবাসেন, প্যাশন হিসেবে দেখছেন। দুই. আর কোন সেক্টরে কাজের সুযোগ নেই বা পারবেন না। তবে যারা প্যাশন হিসেবে দেখেছেন তারা অনেক ইনভেস্ট করে এই সেক্টরে জায়গা করে নিয়েছেন। আবার যারা একমাত্র উপার্জনের সম্ভাবনা দেখে এসেছেন তারাও এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করছেন। এই শিল্পের সবচেয়ে ভালো দিক হলো পুঁজি যাই থাক না কেন, কাজ করার সুযোগ আছে। যা অনেক সেক্টরেই নেই। দিন দিন এর পসরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সেক্টরে এখন নতুন উদ্যোক্তারা আসছেন। তারাই মূলত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির রূপ পরিবর্তন করতে বড় ভূমিকা রাখছেন। এই পরিবর্তনটি চোখে পড়ার মতো।
একসময় মনে করা হতো এই সেক্টরে যারা আসে তারা বোধহয় ভালো ফ্যামিলি থেকে আসেনি। অথবা পড়াশোনায় ভালো নয়। আর কোনো উপায় না পেয়ে এই সেক্টরে এসেছে। এটাই এই কাজের সবচেয়ে বড় বাধা। দ্বিতীয়ত, এই সেক্টরে যখন কাজ করছে, তখন যে কোনোভাবেই হোক প্রশ্ন তোলা হয় তার সম্পর্কে। সেটি আরও বড় বাধা, একটি নারী এগিয়ে যাওয়ার পথে। অথচ আমরা যদি বিশ্বের দিকে তাকায়, তাহলে দেখা যায় একজন আর্টিস্টকে কত সম্মান দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, লালগালিচা সংবর্ধনাও তাদের দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সঠিক সম্মানটুকু আমরা দিতে পারি না। অথচ পরিবারের এমন কোনো মানুষ নেই, যারা সেলুনে না গিয়ে মাস কাটাতে পারেন। সেটা কিন্তু হয় না। প্রতিটি পরিবারের সব সদস্যই চুল কাটাতে বা নিজেকে পরিপাটি রাখতে সেলুনে যাচ্ছেন। তাহলে এই সেক্টরটিকে কেন এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনও দেখা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, এখন পর্যন্ত মানুষগুলোর মধ্যে হিয়মন্ন চিন্তা রয়েছে।
এরই মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার বড় একটি দ্বার। তা হলো শুধু শিক্ষিত মেয়েরাই নয়, সৌন্দর্যচর্চার ওপর বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে অনেকে ব্যবসা শুরু করছেন। আমাদের দেশের জন্য এটি একটি আশারবাণী। এটা সত্যি যে, বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে পড়ালেখা অনেক জরুরি। অন্যদিকে মেয়েরাও বেশ গুরুত্ব দিয়েছে বিষয়টিকে। অনেকে যেমন সৌন্দর্যচর্চার ওপর বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিতে যাচ্ছে। আবার অনেক দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউট এই বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বিদেশে শিক্ষকরাও এদেশে এসে পড়াচ্ছেন। মোট কথা, বিউটি ইন্ডাস্ট্রির বড় একটি পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু হয়েছে এদেশেও। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আনহেলদি বিউটি পার্লার। শুধু ঢাকায় নয়, প্রতিটি মফস্বল এলাকাতেও অনেক পার্লার রয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় প্রথমে একটি তিন মাস পার্লারে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। হাতে-কলমে কোনো প্রশিক্ষণ না নিয়েই জমানো কিছু টাকা দিয়ে পার্লার খুলে বসেছে। পরে সেও একজন সহযোগী রেখেছে, যে কিনা তিন মাস কাজ দেখে নিজে পার্লার খুলেছে। এভাবেই সারাদেশে হাজার হাজার পার্লার রয়েছে; যা একদমই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এই সেক্টরে অনেকে আছেন যারা ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন। তাদেরও যদি পাঁচটি প্রশ্ন করা হয় সবগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। তার অন্যতম কারণ, প্রপার এডুকেশনের অভাব। তারা যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিউটি পার্লার চালু করতেন, তাহলে এই সেক্টর আরও অনেক ডেভেলপ করত। সুখের বিষয় হচ্ছে, এখন যারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তারা পুরোপুরিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেই আসছেন। বিদ্যার্জন এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দুই-ই থাকছে তাদের। বাংলাদেশে আরও অনেক বড় সম্ভাবনা রয়েছে এই সেক্টরে। কারণ এখান থেকেই বড় একটা ইনকাম আসছে। সেই সঙ্গে অর্থনীতির চাকা ঘুরাতেও ভূমিকা রেখে চলছে সৌন্দর্য শিল্প। একজন মেয়ে উদ্যোক্তা কমপক্ষে দশটি মেয়েকে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে। মানে তার নিজেরটাসহ ১১টা পরিবার চলছে তার টাকায়।
সেই সঙ্গে সে কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে দারুণভাবে ভূমিকা রাখছে। এটি এখন স্পস্ট। তাই তাকে সম্মান দেওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সর্বোপরি আশা করাই যায়, এই সেক্টরটি আরও বড় রূপ নেবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের জন্য খুলে দেবে সম্ভাবনার অপার দ্বার। তবে এ জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই এগিয়ে আসা শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের স্বার্থে। একটা নারীকে এগোনোর জন্য আরেকটি নারীর হাতই যথেষ্ট। এই শিল্পে যারা অগ্রগামী তারা নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে গোটা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ভাবলে আরও উন্নত হবে। পেছনে যারা আছেন তারাও সামনে এগিয়ে আসতে পারবেন। নিজেদের সুস্পট জায়গা তৈরি করে নিতে পারবেন। এখন এই শিল্পের সঙ্গে ১০ লাখ মানুষ যুক্ত আছেন; যা দ্বিগুণ করতে বেশি সময় লাগবে না। সে ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে। এতকিছুর মাঝেও মনে রাখতে হবে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে হবে আপনাকেই। সম্ভাবনা যতই বাড়বে ততই শক্তিশালী হবে নারী।
লেখক
ফ্যাশন
ব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন