- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
- দেশের অগ্রযাত্রায় আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি
দেশের অগ্রযাত্রায় আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি

আশির দশক থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক কেনাকাটার তীর্থস্থান ছিল নিউমার্কেট, গাউছিয়া ও শাহবাগ। তবে দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি গুটি গুটি পায়ে চলা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই। সে সময়ে ঢাকাকেন্দ্রিক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্র্রির অনেক বড় একটি রেভলিউশন ঘটায় আড়ং। ১৯৮৭ সালের দিকে আড়ংয়ের যাত্রা শুরু হয়, যদিও তার আগে থেকেই ফ্যাশন হাউস হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল নিপুণের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বলতে গেলে প্রথম ফ্যাশন হাউস এটি। এখনকার মতো তখনও পশ্চিমা পোশাকের আধিক্য ছিল। তবে মেয়েদের পোশাকে নয়। আশির দশক থেকেই ছেলেদের পশ্চিমা পোশাকের স্বাদ দিয়েছে ক্যাটস আই। একই দশকের শেষের দিকে দেশীয় শাড়ির বিপ্লব ঘটায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। নব্বইয়ে আসে অঞ্জন'স, কে-ক্র্যাফট এবং রঙ।
শুনতে খুব সরল সোজা মনে হলেও দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পথচলা ততোটা সহজ নয়। মুক্তযুদ্ধের সময় আমার জন্ম। বেড়ে উঠেছি নারায়ণগঞ্জ শহরে। অনেকটা মফস্বল ধরনের এলাকা এটি। এখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব বেশি না হলেও, উন্নয়নের দিক থেকে ছিল অনেক দূরে। সে সময়ের পারিবারিক কেনাকাটাগুলো হতো ডিআইটি মার্কেট বা মীনাবাজার কেন্দ্রিক। কিন্তু শাড়ি মানেই ছিল ভারতীয় বাজার। তখন টাঙ্গাইলে শাড়ির তেমন পরিচিতি ছিল না। বাজার ঘুরে একটা-দুইটা শাড়ি মিলত। যে কোনো উৎসব-পার্বনে বা বিয়েতে ভারতীয় শাড়ির সয়লাব ছিল। সে দেশ থেকে আত্মীয়স্বজনেরা এলেই শাড়ি কিনে আনতেন। তাছাড়া তখন ফেরি করেও বিক্রি হতো ভারতীয় শাড়ি। পরবর্তীকালে সেই জায়গাটি নেয় প্রাইড টেক্সটাইল। দেশি শাড়িতে প্রিন্টের ছোঁয়া তাদেরই হাত ধরে। শাড়ির পাশাপাশি অন্যান্য পোশাকও অনেকটাই ভারতের দখলে। নব্বইয়ের দশকে বেশ জনপ্রিয়তা পায় চায়না প্রিন্ট, চায়না পপলিন। মেয়েরা এসব কাপড় কিনেই জামা তৈরি করত। পরবর্তীকালে সেই জায়গাটিও দখল করে নেয় ভারতীয় থ্রিপিস। ঘুরেফিরে ভারতীয় বাজার বড়সর একটি জায়গা দখল করে রেখেছিল। এটা যদি হয় মফস্বল এলাকা নারায়ণগঞ্জের গল্প। তাহলে ঢাকার অবস্থা কী ছিল তা চোখ বন্ধ করলেই বোঝা যায়।
আমার ঢাকায় আসা চারুকলায় ভর্তির মাধ্যমে। তখন ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে আড়ং ছিল, নিপুণ ছিল, বুনন ছিল। সেগুলোর পোশাক দেখার সৌভাগ্য আমার ছিল না। কারণ নারায়ণগঞ্জের মানুষ তখন ঢাকায় এসে শপিং করত না। এখন তো দেশের শেষ প্রান্ত থেকে ফ্যাশনপ্রেমীরা যে কোনো উৎসবে ঢাকায় এসে শপিং করেন। তাছাড়া বড় বড় ফ্যাশন হাউস পৌঁছে গেছে সবার দোরগোড়ায়। কিন্তু বুটিক থেকে কেনাকাটা তখন ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। দেশীয় শাড়ির অনেক বড় একটি রেভলিউশন ঘটিয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। তারাই প্রথম দেশের ফ্যাশনপ্রেমীদের সঙ্গে তাঁতিদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই কাপড়ের প্রতি আলাদা একটা আগ্রহ জন্ম নেয়। ১৯৯২ সালে যখন চারুকলাতে ভর্তি হই তখন নিজের আগ্রহ নিয়ে ঢাকার বুটিকগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতাম। তারপরই ১৯৯৪ সালে শুরু হয় আমার নতুন পথচলা। রঙ নামে আত্মপ্রকাশ হলো নিজের একটি হাউস। নারায়ণগঞ্জে তখন নকশা নামে মাত্র একটি দোকান ছিল। আমি কাজ শুরুর পর ছোট-বড় প্রায় ছত্রিশটি বুটিক হয়। এলাকাজুড়ে দারুণ একটি কালচার তৈরি হয়েছিল, যার মূলে ছিল দেশি কাপড়। ঢাকাতে তখন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরকে কেন্দ্র করে বেইলি রোডভিত্তিক আরও কিছু তাঁতের শাড়ির বুটিকের কার্যক্রম শুরু হলো। সব মিলিয়ে দেশি কাপড় বিক্রির সুবাতাস তখন ঢাকাজুড়ে। এটা বেশ বড় একটি অর্জন ছিল দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য।
আমার শুরুটা যদিও পাঞ্জাবি দিয়ে, পরবর্তী সময়ে শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করি। তার একটা কারণ ছিল, আশপাশের বুটিক হাউসগুলো সালোয়ার-কামিজ এবং পাঞ্জাবি নিয়ে বেশি কাজ করত। তখন প্রাইড টেক্সটাইলের ২৬০ টাকার থান শাড়ি পাওয়া যেত। সেই শাড়িতে নিজ হাতে আঁকিবুকির কাজ করতাম। এই শাড়িগুলো সবার আগে বিক্রি হয়ে যেত। পরবর্তীকালে প্রাইডের ২৯০ টাকার প্রিন্টের শাড়ি নিয়ে যেতাম নারায়ণগঞ্জে বিক্রি হতো ৩১০ টাকায়। রঙ প্রথমে কাপড়ের শোরুম ছিল না, ইভেন্টের কাজ করতাম। বিয়ে বাড়ির স্টেজ, জন্মদিনের স্টেজ, র্যালির প্রপ তৈরি করতাম। ছবি আঁকার সরঞ্জাম তখন নারায়ণগঞ্জে পাওয়া যেত না। নিউমার্কেট থেকে নিয়ে সেখানে রাখা হতো। এক থেকে দুই বছর পর নিজেদের তৈরি কাপড় বিক্রি শুরু হয়। একটা সময় টাঙ্গাইলের শাড়ি রাখা শুরু করলাম। রতন বসাক নামে একজন তাঁতি শাড়ি দিতেন। এটা শুধু আমার হাউস তৈরির গল্প নয়। প্রতিটি দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো পেছনে রয়েছে এমন অনেক অনেক অজানা গল্প। যেটা কিনা আমাদের দেশের কথা বলে, মানুষের চাহিদার কথা বলে। তাদের পাওয়া না পাওয়ার কথা বলে। কিন্তু বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যাশন ব্র্যান্ডে এমন গল্প নেই। এটাই আমাদের বড় অর্জন। আমরা দেশি কাপড় নিয়ে কাজ করি, দেশের তাঁতিদের নিয়ে কাজ করি, দেশের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করি, যা পশ্চিমা ধাঁচের ব্র্যান্ডগুলোতে নেই। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির রেভলিউশনের পেছনে মিডিয়ার বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। বেসরকারি চ্যানেলগুলো একটি অংশ রেখেছিল ফ্যাশন প্রোগ্রামের জন্য। আবার পত্রিকাগুলোও রেখেছে ফ্যাশন পাতা। যেখানে বিভিন্ন উৎসবভিত্তিক পোশাক নিয়ে চলে নানা আয়োজন। তাই তো ঈদ উৎসবের পাশাপাশি আরও কিছু সময়ে দেশি পোশাকের বিক্রি বাড়তে থাকে।
দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় ধাক্কা পশ্চিমা পোশাকের আদলে তৈরি ব্র্যান্ড। কারণ দেশীয় ফ্যাশন বা বুটিকের সেটআপ খুবই সীমিত। তারা সবচেয়ে বেশি কাজ করে হাতে তৈরি কাপড় নিয়ে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্র্যান্ডশপের পুরো সেটআপ ভিন্ন। বেশিরভাগই মেশিনের ব্যবহার। তাই অল্পসময়ে বেশি পোশাক তৈরি করতে পারে। এছাড়া তাদের ফেব্রিকও দেশীয় নয়। বিভিন্ন ইম্পোর্টেড ফেব্রিক দিয়ে তৈরি হয় পোশাক। তাই দেশীয় কাপড় থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এসব পোশাক। অনেকেই বলতে পারেন এটা কম্পিটিশনের যুগ, নতুন কিছু তো আসবেই। সেগুলোকেও স্বাগত জানাতে হবে। অবশ্যই তাই। কিন্তু সেটি করতে হবে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করে। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে এবং করছে। সেটি কতটুকুইবা ফলপ্রসু হবে। নিজেদের স্বকীয়তা রেখেই কো-ব্র্যান্ড এনেছে দেশী হাউসগুলো। যেমন, কে-ক্র্যাফটের ইয়াংকে, অঞ্জন'সের মারজিন, আড়ংয়ের তাগাম্যান এমন অনেক কিছু।
আমাদের দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে সঠিকভাবে দাঁড় করাতে চাইলে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। পুরো বিশ্বে পোশাক বিক্রি হয় মৌসুমকেন্দ্রিক। কিন্তু আমাদের দেশে উৎসবকেন্দ্রিক। সে উৎসবেও রয়েছে অনেক ভাগ। পহেলা বৈশাক, বসন্ত বা স্বাধীনতা দিবসেই কেবল বিক্রি বাড়ে দেশীয় পোশাকের। আবার ঈদ, বিয়ে বা পার্টিতে নির্ভর করে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক বা ইন্ডিয়ান-পাকিস্তানি ড্রেসে। হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন তাহলে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো কেন বিদেশি কালচার ফলো করছে না। সবাই তো আধুনিক হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না দেশীয় হাউস। সেখানেও রয়েছে বেশ বিপত্তি। আমাদের অনেকেরই ধারণা হয়ে গেছে পার্টি ড্রেস দেশীয় হাউস তৈরি করতে পারে না। তাছাড়া এসব পোশাক তাদের বানানোরই বা কী দরকার! কিন্তু আমাদের হাল ছাড়লে চলবে না। বিদেশি ইন্ডাস্ট্রি যেমন আমাদের পোশাক নিয়ে কাজ করছে। তেমনি আমাদেরও সময় এসেছে বিদেশি ট্রেন্ডকে নিখুতভাবে ফলো করা।
এতো কিছুর পরও দিন দিন তাঁতের শাড়ির বিক্রি বাড়ছে। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোতে এখন দেখা মিলছে ত্রিশ হাজার থেকে লাখ টাকার শাড়ি। জামদানি, কাতান সেই সঙ্গে মসলিন শাড়িতে আসছে নতুনত্ব, যা বিদেশি হাউসগুলোর পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাঁতপল্লি যেন আবারও ফিরে পাচ্ছে তার পুরোনো রূপ। তাত কাপড়ের মান বৃদ্ধি পেলে দেশি পোশাকেরও কদর বাড়বে। এটা দেশীয় ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক বড় একটি অর্জন হতে পারে। তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি বিশ্ব ফ্যাশনের সঙ্গে পরিচিত। তারা নিজ উদ্যোগেই বিশ্বমানের এবং ট্রেন্ডি পোশাক নিয়ে কাজ করছে। এর সঙ্গে শুধু দেশীয় ফেব্র্রিকের ব্যবহার এবং দেশীয় উপকরণের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সবসময় চিন্তা করেছে মধ্যবিত্ত মানুষের কথা। কিন্তু এখন ভাবতে হবে দেশে উচ্চবিত্তের সংখ্যাও কম নয়। তাই দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে বিশ্বমানে রূপ দেওয়ার এখনই উত্তম সময়।
লেখক
ফ্যাশন ব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন