শোবিজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বেশিরভাগই ভালো পরিবর্তন বলে মনে হয়। দর্শক এখন সবকিছু দেখেন, খোঁজ রাখেন। সিনেমা কিংবা ওটিটি'র কথাই ধরুন- এখানে নতুন ওয়েব তৈরি হয়েছে। নির্মাতারা ব্যস্ত নতুন কাজে। মৌলিক গল্প নিয়ে তাঁরা চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন। দর্শক এটি সাদরে গ্রহণ করছেন। দলবেঁধে সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে আসছেন দর্শক। এ যেন নতুন আশার আলো, যার জন্য এতদিন ছিল অপেক্ষা। দর্শকের এমন ঢল গত কয়েক বছরে আমরা দেখিনি। আমার মনে হয় যে চলচ্চিত্রের জন্য এখন শুভ সময়। এটি কতদূর বজায় থাকে সেটি দেখার বিষয়।

করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাদের দীর্ঘ সময় লকডাউনে থাকতে হয়েছে। মানুষজন ছিল ঘরবন্দি। তখন ঘরে বসে সবাই নেটফ্লিক্স, বিদেশি নানা কনটেন্ট দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সময় বদলেছে। আগে যাঁরা বিদেশি কনটেন্ট দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, সেসব দর্শকই এখন দেশি কনটেন্ট সাবস্ট্ক্রাইব করে দেখছেন। নানা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। সিনেমা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীরা আমাদের যে কোনো কনটেন্ট দেখার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন।

কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছে মেজবাউর রহমান সুমনের সিনেমা 'হাওয়া'। দেশে মুক্তির পরপরই আমেরিকার দর্শকরা দেখেছেন সিনেমাটি। শুনেছি, ওই দেশের টপ লিস্টের ভালো জায়গায় সিনেমাটি অবস্থান করেছে। এটি আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য সুখকর। বিষয়টি নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। গ্লোবালাইজেশন হচ্ছে। নিউ মুভমেন্ট হচ্ছে বাংলা কনটেন্টের। এটি খুবই ইতিবাচক। সামাজিক মাধ্যম ও ইউটিউবের কল্যাণে আমাদের কাজ সবার কাছে পৌঁছানো এখন অনেক সহজ। শুধু দেশ নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ কাজগুলো এখন বহির্বিশ্বের মানুষরা দেখছেন।

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ক্রমেই জনপ্রিয় হওয়ায়, টিভি মিডিয়া কোণঠাসা হয়ে পড়েছে- এমন কথা বলছেন কেউ কেউ। আমি এটি মানতে নারাজ। ওটিটির সঙ্গে টিভি মিডিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। টিভি নাটক আর ওটিটির অডিয়েন্স একেবারে আলাদা। ওটিটির দর্শক টাকা দিয়ে তাঁদের পছন্দের কাজ দেখছেন। এখানে প্রতি মিনিটই মূল্যবান। প্রতি সেকেন্ডই আপনার টাকা খরচ হচ্ছে। সে কারণে ওটিটির দর্শক কনটেন্টের ব্যাপারে খুব সচেতন। নিজের পয়সা খরচ করে দেখা মানে আপনার সেখানে পূর্ণ মনোযোগ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। নাটকের অডিয়েন্স আগেও ছিল। এখন আরও বেশি বেড়েছে। টিভিতে নাটক প্রচারের পর ইউটিউবে কনটেন্টগুলো আপলোড হয়ে যায়। সে কারণে আমাদের যে কোনো কাজই মানুষের চোখে পড়ছে। বেশি বেশি আলোচনা হচ্ছে। আগের চেয়েও যে কোনো কাজে বেশি সাড়া পাচ্ছি। ওটিটির অডিয়েন্সও বাড়ছে। দর্শক চাহিদার কথা মাথায় রেখেই বিশ্বমানের কনটেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় শামিল হতে ভালো কনটেন্ট উপহার দিচ্ছেন দেশীয় নির্মাতারা। সেটা দর্শক সাদরে গ্রহণ করছেন।

আপনি যতই বিদেশি কনটেন্ট দেখুন না কেন, সেখানে আমাদের গল্প আপনি দেখতে পারবেন না। আমাদের গল্প শুধু দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখতে পাবেন। একটা মিডল ক্লাসের অডিয়েন্স অনেকদিন ধরে ওটিটির জগতে অনুপস্থিত ছিলেন। এখন তারা ধীরে ধীরে ওটিটির প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন।

নানা ধরনের গল্প নিয়ে কাজ হচ্ছে এখন। সমসাময়িক ইস্যুগুলো চলে আসছে। এখন দর্শক গল্পপ্রধান কাজ পছন্দ করছেন। সিনেমার গল্প এখন প্রেম-প্রতিশোধের মধ্যে আটকে নেই। কনটেন্ট ভালো হলে দর্শক দেখছেন। অমুক হিরো কিংবা তমুক হিরোইন আছেন, এ জন্য আমি সিনেমা দেখছি- এ বিষয়টি এখন যেন অনুপস্থিত। গল্পের প্রয়োজনে যাকে লাগে নির্মাতারা তাঁকেই কাস্ট করছেন। মাঝে নারী চরিত্র নিয়ে সিনেমায় কাজ কম হয়েছে। ওই সময় হিরোইজম কিংবা অ্যাকশন ঘরানার ছবি বেশি হতো। নারীকে শুধু হিরোর সঙ্গী ও কিছুটা বাণিজ্যিক চিন্তা মাথায় রেখে উপস্থাপন করা হতো। নির্মাতাদের চিন্তা-চেতনা বদলেছে। এখন নারী চরিত্র প্রাধান্য পাচ্ছে নাটক-সিনেমায়।



বেশি বছর হয়নি আমি মিডিয়ায় এসেছি। কিন্তু দর্শকদের অফুরান ভালোবাসা পেয়েছি। সেই ভালোবাসার ডানায় ভর করেই এগিয়ে চলছি। ক্যারিয়ারে এই অবস্থানে আসতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখন দেখছি সবাই অল্প পরিশ্রমে সাফল্য পেতে চান। আজকে এসে কালকে তারকা বনে যেতে চান। খ্যাতি পাওয়ার জন্য তাঁরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। এর জন্য যে অধ্যবসায় দরকার তা তাঁদের মাথায় থাকে না। এখন পরিচিত পাওয়া খুব সহজ। অনলাইনে একটি কনটেন্ট আপলোড দিলেই অনেক ভিউ পাওয়া যায়। ভিউয়ের বড়াই করে কেউ কেউ নিজেকে তারকা ভাবতে থাকেন। আগে পরিচিতি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন অনেক কিছু সহজ। সবাই সবার কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাচ্ছেন। জনপ্রিয়তা পাওয়া আর তারকাশিল্পী হয়ে দর্শক মনে জায়গা করে নেওয়া এক নয়। নিজেকে প্রতিনিয়ত গড়ার জন্য ভালো বই পড়া ও সিনেমা দেখার অভ্যাস জরুরি।

আপনি তখনই একজন ভালো শিল্পী হতে পারবেন, যখন আপনি মনের মধ্যে সেই শিল্পীসত্তাকে লালন করবেন। যখন নিজেকে শিল্পচর্চায় মনোযোগী করবেন, তখনই জীবন বদলে যাবে। আপনার লাইফস্টাইলই যদি হয় রাতবিরাতে পার্টি আর সকালে কাজ করবেন তাহলে আপনি বেশিদিন টিকতে পারবেন না। অভিনয় করে সাময়িক পরিচিত পেলেও একসময় তাঁরা হারিয়ে যান। মানুষ তাঁদের মনে রাখে না। যাঁরা শিল্পকে ভালোবাসেন তাঁরা কিন্তু ঠিকই থেকে রয়ে যান। সবাইকে পরিশ্রম করে একটা জায়গায় যাওয়ার চিন্তা করা উচিত। মিডিয়ায় এখন তারুণ্যের জয়জয়কার। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন তাঁদের চোখেমুখে। দেশের লোকসংখ্যার ৩৫ শতাংশ তরুণ প্রজন্ম। যে জন্য সব ক্ষেত্রেই তাঁরা অবদান রাখছেন। তরুণ নির্মাতারা ট্রপিকগুলো রিপ্রেজেন্ট করতে পারছেন। তাঁদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজনৈতিক চেতনা আছে। তাঁরা সেগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটাকে অনেক বেশি সাধুবাদ জানানো উচিত। আমাদের দেশের তরুণ নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীরা যখন বিদেশের মাটিতে গিয়ে কোনো পুরস্কার পান মনটা তখন আনন্দে ভরে যায়।

এটি গর্বেরও। শুধু দেশের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে হবে তা নয়, স্বপ্ন দেখার পরিধি এখন অনেক বড়। তরুণরা প্রমাণ করেছেন আমাদের সংস্কৃতিকে বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, চাইলে অনেক কিছুতেই সাহস দেখানো যায়। আশা করছি, আগামীতে অস্কার কিংবা গোল্ডেন গ্লোবের মতো মর্যাদাপূর্ণ আসর থেকেও দেশের অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতারা পুরস্কার নিয়ে আসবেন। যখন কেউ পুরস্কার নিয়ে দেশে আসেন, তখন মনে হয় তিনি যদি পারেন, তাহলে আমি পারব না কেন? মনে স্বপ্ন ও আশা জাগে। ভালো কাজের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হই। সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা পাই।

প্রতিটি পেশায় কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই কাজ করতে হয়। হলিউড কিংবা বলিউড কোটি কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। অনেক আয়। আমাদের দেশে সিনেমার বাজার এখনও বড় হয়নি। আর্ট ফর্মটা সেভাবে স্বীকৃত নয়। সেই জায়গা থেকে সুযোগ-সুবিধা কম পাচ্ছি। কিন্তু শিল্পীরা বসে নেই। যে যাঁর জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছেন। এই অঙ্গনের প্রতি সবার দৃষ্টি থাকে। প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হয় মিডিয়াকর্মীদের। ইদানীং কোনো কিছু হলেই মামলা করার ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। নির্মাতারা হচ্ছেন নাজেহাল।

এসবের বিরুদ্ধে কে কাজ করবেন? প্রতিকূলতার মধ্য থেকেও আমরা স্বপ্ন দেখি, সংস্কৃতি আরও ছড়িয়ে পড়বে। কাজের বাজেট ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়বে। সামনে আরও ভালো কাজ আসবে। আমাদের কাজ বিশ্বে যত ছড়িয়ে পড়বে ততই সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। আমরা সহজে হার মানতে চাই না- এটাই বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য। সবাই সবার পাশে থাকব। ইন্ডাস্ট্রিতে এখন ভাঙাগড়ার স্টেজ চলছে। যখন একটু স্থিতি আসবে অনেক কিছুর সমাধান হবে। আমি আশাবাদী মানুষ। যতই পরিবেশ প্রতিকূল হোক না কেন, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে হলেও লক্ষ্য জয় করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাব- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক
অভিনয়শিল্পী
মডেল