রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার
![রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার](https://samakal.com/media/imgAll/2024December/untitled-11-1733770504.jpg)
মুশতাক হোসেন
মুশতাক হোসেন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৫ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৭:০৪
আমরা বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে প্রায়ই হতাশা প্রকাশ করতাম। বলতাম এখনকার ছেলেমেয়েরা মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকে, আশপাশের মানুষ বা দেশের কোনো খবর রাখে না। তাদের দিয়ে কী হবে? দেশে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বন্ধ্যত্ব চলছে। তরুণদের কি কিছুই করার নেই? কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে এ বছরের জুলাই-আগস্টে বুকের রক্ত দিয়ে তরুণ সমাজ সব সমালোচনা আর হতাশার জবাব দিল। ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর থেকে দেশবাসী মুক্তি পেল।
তবে এটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান প্রজন্ম বলতে তো নিরেট একক সত্তা নয়। এর মধ্যে শ্রেণিভেদ, গোষ্ঠীভেদ, জাতিভেদ, ধর্মভেদ রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও রয়েছে শ্রেণিভেদ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মাদ্রাসাছাত্র, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র, বাংলা মাধ্যমের ছাত্র, কওমি মাদ্রাসার ছাত্র প্রভৃতি। এবারের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আশ্চর্যজনকভাবে সব ধরনের সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রী এক কাতারে মিলিত হয়েছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। তাইতো তারা সফল হলো। কীভাবে সেটি হলো, সেটি জানার আগ্রহ থাকবে বহুদিন।
সমাজ পরিবর্তন বা রাজনৈতিক পরিবর্তনে কারা পরিবর্তনের অগ্রদূত হতে পারে? সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন যে, বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থাকা সবচাইতে নিষ্পেষিত, সবচাইতে বিজ্ঞানমনস্ক, পরিবর্তনের জন্য সবচাইতে ক্রিয়াশীল অংশই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাদের মধ্যে যারা সমাজের সব নিপীড়িত অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে, আস্থাভাজন হয় তারা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয় এ সব কিছু বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে আবার এগিয়ে এসেছে। অন্যান্য বারের গণঅভ্যুত্থানে পরিবর্তনকামী সকল ছাত্র সংগঠন একত্র হয়ে সমগ্র নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করেছিল। এবার আমরা ভিন্ন চিত্র দেখলাম। নির্দলীয় রূপের ছাত্ররা নেতৃত্বে ছিল বলেই আন্দোলন সফল হয়েছে।
কেন এমন হলো? প্রধান বিরোধী দল ও তার মিত্ররা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কঠিন সংগ্রাম করেও জনগণকে পরিবর্তনের জন্য মরিয়া সংগ্রামে শামিল করতে পারেনি। বিদ্যমান বিরোধী মতের ছাত্র সংগঠনগুলোও কোনো কার্যকর ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারে সফল আন্দোলনটাও গড়ে উঠেছিল নির্দলীয় চেহারার ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। একই বছরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল নির্দলীয় চেহারার ছাত্র নেতৃত্বের হাত ধরেই। তবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের পেশিশক্তির কাছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন পিছু হটলেও তার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী ছিল, তা ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে টের পাওয়া গেছে। জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রসমাজের যে বিপুল শক্তির প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তা এখন কীভাবে কোন পথে এগোচ্ছে? এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ মুক্তিযুদ্ধে, ’৮০-৯০ দশকের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে বিপুল শক্তির জন্ম দিয়েছিল ছাত্র-তরুণসমাজ তাদের গন্তব্য ও পথচলা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছিল? খুব একটা উজ্জ্বল চিত্র কি আমরা দেখাতে পারব?
২০২৪-এর ছাত্র নেতৃত্ব মূলত ‘ছাত্রশক্তি’ নামক সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তবে আন্দোলনে তারা এটা সামনে আনেননি। কয়েকজন নেতানেত্রী এ সংগঠনের বাইরে থেকেও এসেছেন। অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের কোনো নেতা যেন নেতৃত্বের কাতারে আসতে না পারেন এ বিষয়ে কোটা সংস্কার তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব খুবই সতর্ক ছিল। সম্ভবত তারা সন্দিহান ছিলেন এই ভেবে যে, এতে আন্দোলন দলীয় রাজনৈতিক রং ধারণ করবে এবং সরকার সহজেই তা দমন করবে। কারণ বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করা বিগত সরকারের পক্ষে কখনোই কঠিন ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব তাদের রাজনৈতিক মতামত গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ করছেন। তবে তাদের এ রাজনৈতিক অবস্থান ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের সবাই একমত নন। এর আগে দেখা যাক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শক্তিগুলোর বিন্যাস।
সাম্প্রতিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে মোটা দাগে চারটি শক্তি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এক. নির্দলীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব, তাদের নির্দলীয় ও জীবন বাজি রাখা নেতৃত্বের জন্য সফলতা এসেছে। দুই. সাবেক ক্ষমতাসীন দল বিএনপি ও তার মিত্ররা। তিন. ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। চার. অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান বিজয় লাভ করার পর এ শক্তিগুলোর মধ্যে কেউ কেউ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বলে চালিয়ে দিতে চাইছে এবং অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিকে তা মেনে নিতে বাধ্য করতে চাইছে। এ থেকে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং কোথাও কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মূল সুরটি কি ছিল? এক. ফ্যাসিবাদের পতন ঘটনোর পরে যেন নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম না হয়। দুই. বৈষম্য বিলোপ। নতুন ফ্যাসিবাদের ফিরে আসা ঠেকাতে করণীয় নিয়ে বহুপক্ষ আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। এটি খুবই ইতিবাচক দিক। গোটা রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ব্যাপক মতবিনিময় চলছে। এ বিষয়ে যদি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনা যায়, তবে হাজারো শহীদের আত্মদান সার্থক হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব ও গণঅভ্যুত্থান থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া জাতীয় নাগরিক কমিটি ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ফ্যাসিবাদের উৎস বিবেচনা করে তাকে ‘ছুড়ে’ ফেলতে চাইছে। দেশকে নতুন স্বাধীন বিবেচনা করে ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার দাবি তুলেছে। জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারে সবাই একমত, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য নেই। শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা (যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষ ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন আছে) ও সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় অন্যান্য মূলনীতিকে দায়ী করা যায় না।
যেমনি করে গোটা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের ২৩ বছরের শোষণ ও ১৯৭১ সালের গণহত্যায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ধর্মের দোহাই দেওয়া হলেও এজন্য ধর্মকে দায়ী করা যায় না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তো ইসলাম রক্ষার নাম দিয়ে ২৩ বছরের শাসন-শোষণ ও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। হিটলার তো তাঁর দলের নাম সমাজতন্ত্র রেখেই জার্মানি তথা সমগ্র ইউরোপে ফ্যাসিবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে এবং বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর সব দেশকে ঠেলে দিয়েছেন। তাহলে কি এ যুক্তিতে সমাজতন্ত্রকেও নির্বাসনে পাঠাতে হবে?
ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার পথ বন্ধ করতেই হবে। এটি করার জন্য লাগসই কাজটি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল আদর্শকে এজন্য আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানালে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করার লক্ষ্য হারিয়ে যাবে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র বিরাট একটি ধাক্কা খেয়েছে। এটি যেন পুরোনো রূপে ফিরে আসতে না পারে, সে দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত। সে জন্য রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যন্ত্রগুলোতে আওয়ামী লীগের সমর্থক বদলিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক বসিয়ে দিলেই তা ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়ে যাবে না। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো সংস্কার না করে গোটা প্রশাসন, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সমস্ত অংশ দলীয় কর্মীদের দ্বারা দখল করেছিল। বলেছিল, এটি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করবে। কী হলো? সামরিক ফ্যাসিবাদের জায়গাতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল কি? দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণকে তারা কতটুকু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন? বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু গ্রহণীয় করাতে পেরেছেন? আজ যে আবার ধর্মীয় উগ্রতা ও ফ্যাসিবাদী আলামত দেখা যাচ্ছে তার জন্য কি শেখ হাসিনা সরকারের দায় নেই? ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর যে অসম্মান হলো সেটির দায় কি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার এড়াতে পারবে? তারা সাড়ে ১৫ বছর কী প্রতিষ্ঠা করলেন? এর মূল কারণ হলো বিগত সরকার স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের জুতায় নিজেদের পা ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষমতার বিলাসিতা উপভোগ করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তো দূরের কথা, যেখানে যতটুকু গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা ছিল তার ফ্যাসিবাদী রূপান্তর ঘটিয়েছে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমাদের বিরাট প্রত্যাশা রয়েছে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার তারা শুরু করবেন। বৈষম্য দূর করার জন্য সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে সংঘবদ্ধ ও ক্ষমতাশালী করে তাদের দিয়েই দারিদ্র্য-শোষণ-বঞ্চনা দূর করার কাজটি শুরু করবেন। কাজটা বেশ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ফাঁদে পড়ে নিজেদের ঐক্যকে ছাত্র নেতৃত্ব নষ্ট করবেন না, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও বৈষম্য দূর করার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের অনুসারী হলেও ৫ আগস্টের অংশীদারদের মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, তাকে নষ্ট করতে দেবেন না।
২০২৪-এ যে প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাকে নতুন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কাজে লাগাতে হবে। এটা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। ভুল হতে পারে, তা সংশোধনের চেষ্টা থাকতে হবে। ১৯৭১, ১৯৯০-এ তা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে পরিবর্তন বিরোধী শক্তির দ্বারা। এবার সে চক্রান্তের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। প্রজন্মের পথচলা সামনের দিকেই হোক, পেছনে নয়।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)
স্থায়ী কমিটির, বাংলাদেশ জাসদ
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী