বাংলাদেশের উত্তরণ সম্ভাবনা
মামুন রশীদ
মামুন রশীদ
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৯ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৭:০২
আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যখন সংঘাত-সহিংসতা ও উত্তেজনা একদিকে দেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা নষ্ট করে দিচ্ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সফলতার ওপর কালো ছায়া ফেলছে। তথাপি আমি কেবল কামনা-বাসনা ও প্রার্থনাই করছি না, প্রবলভাবে বিশ্বাসও করি যে বাংলাদেশ কখনোই পথ না হারিয়ে বরং সামনের দিকেই এগিয়ে যাবে।
আমার এমন আশাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে কয়েকটি খাতের সফলতা। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারাবাহিকতা যেমন লক্ষণীয়, তেমনি ক্রমাগতভাবে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পরও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্যোক্তার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। রপ্তানি আয় ও অনাবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহও বেড়ে চলেছে। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে, অন্যদিকে যুব কর্মশক্তি বাড়ছে এবং এতে নারীর অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশি ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জোর দিয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোগেও শিক্ষার বেশ বিকাশ ঘটছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিবছরই দারিদ্র্য কমছে এবং একটি সুন্দর আগামী গড়ে তোলার সংগ্রামেও মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ মাত্র ৯ মাস স্থায়ী হয়েছিল। সমগোত্রীয় অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধও যদি দীর্ঘায়িত হতো তাহলে এই মাটিতে শুধু আরও অনেক বেশি আক্রমণ, প্রাণহানির ঘটনাই ঘটত না, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয়ে উঠত অকল্পনীয়; যা সদ্য স্বাধীন একটি দেশের পক্ষে পুষিয়ে নেওয়া কষ্টকর বা অসম্ভব হয়ে পড়ত।
১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বিশেষ করে এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল গ্রামাঞ্চলে। তবে এর একটি ভালো দিকও ছিল। সেটি হলো, তখন থেকে গ্রামের মানুষজন আয়-রোজগারের জন্য শুধু শহরেই নয়, সেই সঙ্গে বিদেশ তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও যেতে শুরু করে। পরবর্তীকালে এই প্রবণতা আরও জোরালো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ থেকে প্রবাসী মানুষের সংখ্যা বেড়ে কোটি ছাড়িয়ে গেছে। প্রবাসে থাকা এসব অনাবাসী বাংলাদেশি তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা তথা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠানোর মাধ্যমে আরও লোকজনের বিদেশ যাওয়ার পথ সুগম করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলছেন এবং সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের এই অর্থনীতিতেও যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছেন। প্রবাসী বা অনাবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই যায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে, যা অনেক আগেই ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স ও ব্যাপক হারে ক্ষুদ্রঋণ নেটওয়ার্কের বিস্তৃত হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অমিত সম্ভাবনা জাগিয়েছে এবং সেই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বিরাট অবদান রেখেছে। অর্থনৈতিক বা উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা দেশ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর জোর দিয়ে এবং উন্নয়ন অংশীদারদের চিন্তাশীল সহায়তায় আমাদের সরকারগুলোও ধারাবাহিকভাবে গ্রামাঞ্চলের জনগণের আর্থিক বা উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ড বাড়াতে মধ্যমেয়াদি ও মৌসুমি কর্মসূচি হাতে নেয়, যা দেশে উল্লেখযোগ্য হারে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক হয়। এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার পাশাপাশি শহুরে বস্তিবাসীর জন্যও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটায় এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে গড় পড়তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় তা বাংলাদেশের জন্য সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যের (এমডিজি) অনেকগুলোই দ্রুত অর্জন কিংবা ছাড়িয়ে যেতেও বেশ সহায়ক হয়েছে।
যদিও বড় কোনো সংস্কার হয়নি বললেই চলে, তবুও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মাঝে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এসব সংস্কারের বেশির ভাগই করা হয়েছে উন্নয়ন অংশীদারদের দ্বারা তাড়িত হয়ে। তবে এখনও প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়ের ঘাটতি ও দীর্ঘসূত্রতা লক্ষণীয়। তা সত্ত্বেও উন্নয়ন অংশীদারদের সহায়তায় নেওয়া বৃহৎ অবকাঠামো বা পল্লি স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, সংযোগ সড়কের উন্নয়ন এবং এমনকি ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কর্মসূচিগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও সরকারগুলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী ও তদারকি মন্ত্রণালয়কে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছে। বেসামরিক আমলারা উন্নয়ন সংস্থাসমূহ বা বিদেশি সরকারের সহায়তায় প্রশিক্ষণ পেয়ে ভবিষ্যৎমুখী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বেশ অবদান রেখেছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণ ও অব্যাহত প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের সামরিক আমলাতন্ত্রও এখন একটি উত্তরণকালীন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির প্রবণতা, পরিচালনা ও পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ইত্যাদি বুঝতে পারছে।
তহবিলের ঘাটতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব, দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কখনোই ভালো শিক্ষার পথটি হারায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, ফার্মাসি প্রভৃতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রকৌশলীরা বিশ্ব পরিমণ্ডলে মর্যাদার আসনে আসীন। অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর এবং অপেক্ষাকৃত নবীন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ও দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। শিক্ষায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে উপযুক্ত ব্যক্তিদের বসানোর ফলে প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বৈশ্বিক মান ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট বা স্নাতক ডিগ্রিধারীরা বেরিয়ে আসতে পারছেন। একই সঙ্গে অল্প কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও দ্রুতগতিতে উচ্চ শিক্ষার ঘাটতি ও চাহিদা পূরণ করে চলেছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আজ প্রতিযোগী এবং সমগোত্রীয় অনেক দেশের তুলনায় বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত সন্তোষজনক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নেটওয়ার্কের জন্য কৃতিত্বের দাবিদার। আমাদের চিকিৎসকরা সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে হৃদরোগ, লিভার বা যকৃত, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ ও নিউরোলজি চিকিৎসায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়ে চলেছেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগ মানে এখন একটি সাফল্যের গল্প। কারণ আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের বহুমাত্রিকতার মধ্যেও ‘টিকে থাকার কৌশল’ শিখে ফেলেছেন এবং জাতীয় মূলধন গঠনে বেশ অবদান রাখছেন। তারা শুধু পোশাক খাতের ব্যবসাতেই বৃহৎ ও নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং বড় আকারের বস্ত্র, ফার্মাসিউটিক্যালস, স্টিল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং ভোগপণ্য কারখানা স্থাপন এবং ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক গঠনের মাধ্যমেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটিয়ে নিজেদের নেতৃত্বগুণের প্রমাণ দিয়েছেন। আমাদের ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকবান্ধব পণ্য-সেবা, অটোমেশন, বিকল্প ব্যাংকিং চ্যানেলের ঘাটতি ও ক্রস বর্ডার ট্রেড বা আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যে সক্ষমতার অভাব থাকলেও দিন দিন এসব ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন তথা উন্নয়ন ঘটছে। তবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ইতোমধ্যে বহুমাত্রিক আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সামলানো ও মোবাইল কমার্সের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আমাদের নারী সমাজ ও মিডিয়া বা গণমাধ্যম তাদের কার্যক্রমে নৈপুণ্য দেখিয়ে তারকায় পরিণত হয়েছে। অনেক নারী নিজ নিজ পেশায় ব্যাপক সফলতা দেখিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এ ধরনের নারীর সংখ্যা আবার দিন দিন বাড়ছে। আমাদের মিডিয়া বা গণমাধ্যমও সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীদের মালিকানায় পরিচালিত হলেও কখনোই তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ও জবাবদিহিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করার পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের একটি অন্যতম সাফল্য হলো, বড় ইসলামী দলগুলোও বিজ্ঞানমুখী শিক্ষানীতি, কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে নারীদের অবস্থানের বিরুদ্ধে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে আছেন দুই নারী, যারা দীর্ঘদিন ধরে দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এতে তাদের অনেক নারী সহকর্মীও আস্থার সঙ্গেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগে কয়েকজন বাণিজ্যনীতি বিশ্লেষকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাদের সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকারের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। তখন একজন জ্যেষ্ঠ নারী কর্মকর্তা চট করেই আমাকে বললেন, ‘বাংলাদেশ বেশ স্বচ্ছন্দেই ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে থাকে। এসব দেশ কিন্তু নন-এলডিসি অর্থাৎ এলডিসিভুক্ত নয়।’ সে জন্য তিনি বাংলাদেশকে আর এলডিসি হিসেবে বিবেচনা করতে রাজি নন বলে জানান। বরং তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে যদি তার প্রধান রপ্তানি পণ্য ‘তৈরি পোশাকে’ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এ অর্থাৎ বাংলাদেশি পণ্যের বন্যা বয়ে যাবে। তিনি অনেকটা উচ্চস্বরেই আমাকে বললেন, আফ্রিকার দেশগুলোকে ‘আফ্রিকান গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্ট’ (আগোয়া), লাতিন আমেরিকান দেশগুলোকে ‘নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের’ (নাফটা) আওতায় সুবিধা দেওয়া হলেও তারা কেউই এর সদ্ব্যবহার বা তেমন কিছু করতে পারেনি। ভদ্রমহিলা না থেমে বলতে থাকেন, “লাতিন আমেরিকার মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শব্দ হলো ‘টুমোরো’ বা আগামীকাল। ‘আমরা এটি আগামীকাল করব’ বলে তারা সবকিছুই ফেলে রাখে। আবার আফ্রিকার নারীরা তাদের মোটা আঙুলগুলো দিয়ে বেশি কিছু করতে পারেন না। অথচ আপনাদের দেশের নারীদের দেখুন। তারা শত শত বছরের পরম্পরায় সুচের কত কারুকার্যময় পোশাক তৈরি করে আসছেন। তাদের আঙুলগুলোই যেন শুধু নান্দনিক ডিজাইন বা নকশার পোশাক তৈরির জন্য।” ওই ভদ্রমহিলার পাশে বসা লোকটি আমাকে বললেন, কীভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়, সেই কৌশল গোটা বিশ্বকে শেখাতে পারে বাংলাদেশ। তাঁর মতে, ‘সম্ভবত বাংলাদেশই হলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিরোধক্ষম বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার শক্তিসম্পন্ন জাতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যা কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হলে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে বা ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাদেশের জুড়ি মেলা ভার।’
বাংলাদেশ বেশ স্বচ্ছন্দেই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অগ্রদূত বা অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে এবং সফলতার সঙ্গেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা লাভ করেছে। এখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের মৌলিক যোগ্যতা বা সামর্থ্য গড়ে তোলাই নয়, বরং তা সম্প্রসারণ বা জোরদারকরণেরও সময় এসে গেছে। বিশ্বসম্প্রদায়ের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে আমাদের আরও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজস্ব ও বাজার সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের যথাযথভাবে তদারকি প্রতিষ্ঠান/সংস্থাসমূহের সক্ষমতা জোরদার করা দরকার। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও ব্যাপকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে হবে। আমাদের আদালত বা বিচার ব্যবস্থাকেও নিশ্চিত করতে হবে বৃহত্তর জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বা তার কাছাকাছি সেবা। সেই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে যেমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলন ঘটতে হবে লাখো-কোটি মানুষের প্রত্যাশা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও উন্নততর গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের পেশাগত জগতে প্রবেশের জন্য তৈরি করার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশকে সফলতার সঙ্গে চূড়ান্ত উন্নয়নের পথে পরিচালিত করতে আমাদের আরও অধিকসংখ্যক শিক্ষিত যুবক-যুবতী সমাজ দরকার, যারা সামনে থেকে এ দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেবেন। বাংলাদেশ এখন পরিবর্তনের ধারায় রয়েছে এবং সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। সাময়িক কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিলেও ত্বরান্বিত হচ্ছে অর্থনৈতিক উত্তরণ, বিনিয়োগে ঘটছে রূপান্তর, আকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মসংস্থান, হ্রাস পাচ্ছে দারিদ্র্য, বাড়ছে প্রযুক্তি চালিত সমাধান এবং জোরদার হচ্ছে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে হলে আমাদের আরো ভালো নেতৃত্ব চাই, যা চলমান উত্তরণ প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করবে। আমাদের উচ্চহারে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক খাতগুলোতে বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি অর্জনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমন সব বড় প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন এবং সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে জোরদার সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী