ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

প্রাকৃতিক মাছ, মৎস্যজীবী ও ভ্রান্ত উন্নয়ন চিন্তা 

প্রাকৃতিক মাছ, মৎস্যজীবী ও ভ্রান্ত উন্নয়ন চিন্তা 

ফরিদা আখতার

ফরিদা আখতার

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০১ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৭:০০

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ কত আছে তা হয়তো এ দেশের মানুষের নিজেদেরই জানা নেই। সব প্রাকৃতিক সম্পদের কথা নাই বা বললাম, শুধু মাছের কথাই ধরা যাক। প্রকৃতি থেকে পাওয়া মাছে ভরে আছে দেশের শত শত নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়। বঙ্গোপসাগরও আমাদের প্রতি উদার হয়ে অনেক প্রজাতির মাছ সরবরাহ করছে। মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্বাদুপানির মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২৬০ ও সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৪৭৫– সব মিলে ৭৩৫ প্রজাতির মাছ আছে; যা এ দেশের মানুষের প্রতিদিনের আমিষ খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। পুঁটি, শৈল, শিং, মাগুর, টেংরা, বোয়াল, পাবদা কত রকমের নাম। এদের প্রাপ্তিস্থান ভিন্ন; আকৃতি ও স্বাদও ভিন্ন। ঢাকা শহরের মানুষ রুই, কাতলা, কৈ বা মাগুর ছাড়া অন্য মাছের নাম বলতে না পারলেও যেখানে নদী, জলাশয়, হাওর-বাঁওড় আছে, সেখানকার ছেলেমেয়েরা নানা জাতের মাছের নাম বলতে পারবে। কারণ তারা নিজেরা এ মাছ ধরে এবং খায়। এ মাছ দেখেই তারা বড় হয়। গ্রামে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা নদীতে গোসলে যাওয়ার সময় মায়ের কথামতো কিছু মাছ ধরে নিয়ে আসে। এটাই তাদের খেলা, দুষ্টুমি আবার তাদের বেঁচে থাকার উপায়। মাছ তাদের পুষ্টির উৎস। কিন্তু উন্নয়ন চিন্তায় এই প্রকৃতি রক্ষার কোনো চেষ্টা নেই। উন্নয়ন মানে সড়ক, উন্নয়ন মানে গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়া। মাছের কথা, মৎস্যজীবীদের কথা শুনলে এবং জানলে এই উন্নয়ন নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবা যেত। 

প্রকৃতি থেকে পাওয়া মাছ মানুষের কোনো ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে না। প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তারা নির্দিষ্ট সময়ে ডিম পাড়ে এবং বড় হয়। এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা মাছ আহরণ করেন নির্দিষ্ট জাল দিয়ে। তারা জানেন এই মাছ কখন ডিম দেয়, কখন বড় হয়। তারা সেভাবেই তাদের পরিকল্পনা করেন। কাজেই নির্দিষ্ট প্রজনন মৌসুমে মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশ করে দেওয়ার মাধ্যমেই প্রাকৃতিক মাছের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এ সময় জোর জবরদস্তি করে নিজেদের মুনাফার জন্য মাছ না ধরে মাছকে বেড়ে উঠতে দেওয়াটাই একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। হাওরে বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে হাওরের মাছের প্রজনন কাল। মা ইলিশ ডিম ছাড়ে কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমায়। এই এক অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার। মৎস্যজীবীরা এসব বোঝেন এবং নিজেরা কষ্ট করেও মাছ ধরা থেকে বিরত থেকে মা মাছকে ডিম পাড়ার সুযোগ দেন। মাছের সঙ্গে মৎস্যজীবীদের এ বোঝাপড়ার কারণেই মাছের সরবরাহ ঠিক থাকে। সরকার এ সময় মৎস্যজীবীদের কিছু খাদ্য সহায়তা দেয়।  

ডিম থেকে এই মাছ বড় হয়ে খাদ্য হিসেবে আমাদের পাতে ওঠে। কিন্তু এ বিষয়টা মৎস্যজীবীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; কারণ এক শ্রেণির মৎস্য ব্যবসায়ীরা সময়ে-অসময়ে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসেন। তারা মৌসুম মানেন না, জালের ধরন না মেনে নির্বিচারে মাছ ধরেন। ক্ষতিকর এবং নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করেন। এসব জালের বাহারি নাম আছে– কিরণমালা, চায়নাদুয়ারি, মশারি, কারেন্ট জাল ইত্যাদি। এসব জাল নিষিদ্ধ কিন্তু তবুও এই জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ ধরা হচ্ছে। এতে মাছের পাশাপাশি হাজার হাজার জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংস হয় জলজ প্রাণবৈচিত্র্য। তারা একবারেই সব লাভ করে ফেলতে চান। এমন কি পানিতে ওষুধ ঢেলে দেন যেন মাছ ভেসে ওঠে এবং সহজে যেন মাছ ধরা যায়। এমন ধ্বংসাত্মক কাজ করতেও তারা পিছপা হয় না। অথচ যারা মৎসজীবী, যাদের জীবন-জীবিকা প্রকৃতির এই মাছ আহরণের সঙ্গে যুক্ত তারা ঠিকই বিরত থাকেন। তারা কখনোই নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে প্রকৃতিকে ধ্বংস করেন না। এ সময় তারা আয়-রোজগার করতে না পারলেও তারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকেন। সালাম জানাই তাদের। 

বাংলাদেশে হাওরের মূল জায়গা হচ্ছে সিলেটে বিভাগে ৭টি জেলা, এখানে ৩৭৩টি হাওর আছে। মৎস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী হাওরে এসব হাওরে ১৪৩ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক মিঠাপানির মাছের বড় উৎস হচ্ছে এই হাওর বা গামলা আকৃতির জলাভূমি। মোট আয়তন ২.৬৩ লাখ হেক্টর। বছরে মাছের পরিমাণ ১.৭০ লাখ মেট্রিক টন। হাওরগুলোর নামও অনেক রকম। যেমন– টাঙ্গুয়া, হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, নাওটানা, লক্ষ্মীপাশা ইত্যাদী। এখানে প্রায় ৩ লাখ, ৬২ হাজারের বেশি মৎস্যজীবীর জীবিকা আসে এ হাওর থেকে। তাদের খবর কেউ রাখে না। দেশের মাছ সরবরাহের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আসে হাওর থেকে; এ মৎস্যজীবীরাই এই মাছ সংগ্রহ করে শহরে পাঠান। যদিও হাওরের কথা বললে মাছের কথাই মনে হয়, কিন্তু হাওরে গবাদি পশু, হাঁস, পাখিসহ স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ। হাওর ধানের জন্যও পরিচিত, বেশ কয়েক প্রজাতির স্থানীয় ধান রয়েছে।   

নিরীহ এ মৎস্যজীবীদের ওপর হাজার ধরনের সমস্যা এসে জড়ো হয়। ইদানীং হাওরের দিকে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের নজর গেছে। তারা সেখানে গিয়ে চিপসের খালি প্যাকেটসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক আবর্জনা হাওরকে উপহার দিয়ে আসছেন। এতে মাছের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে মৎসজীবীরা উদ্বিগ্ন। হাওরের প্রতি ভালো বাসায় বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে, রাস্তা ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি নির্মিত হয়েছে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রাস্তার ওপর প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বৈশাখী আলপনাও আঁকা হয়েছে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা পেতে প্রায় দু’দিনের বেশি সময় ধরে ৬৫০ জন শিল্পী এ কাণ্ডটি করেছেন। একবারও ভাবেননি, এ রংয়ের কেমিক্যাল পানিতে গেলে মাছের কী হবে? 

পরিবেশবাদী এবং বিশেষজ্ঞরা অনেক আপত্তি জানিয়েছেন। কারণ এ আলপনায় ঢাকা পড়েছে সড়কের থার্মোপ্লাস্টিক রোড মার্কিং (পথনির্দেশক চিহ্ন); বৃষ্টির সময় বা পানিতে সড়কটি পিচ্ছিল হতে পারে। এতে দ্রুতগতির গাড়ির চাকা পিছলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সড়কটির কারণে পানির প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে; ফলে মাছেরও অসুবিধা হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরাও আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেছেন, এ সড়ক পানিপ্রবাহ ব্যাহত করছে; ফলে বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ভাটিতে পানি জমে যাচ্ছে। পানি প্রবাহের গতিও কমে গেছে। বিশিষ্ট পরিবেশবাদী আব্দুল করিম কিম অভিযোগ করেছেন, কোনো ধরনের পরিবেশ মূল্যায়ন না করেই এ সড়ক তৈরি করা হয়েছে। হাওরের পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ নষ্ট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সুনামগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জের পানি মেঘনা নদীর মাধ্যমে সিলেটে আসে, কিন্তু ইটনা-মিঠামাইন সড়কটি এই পানির প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।    

কৃষকরাও চিন্তিত। হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধানেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে হাওরে পানি এসে নদীতে চলে যায়। কিন্তু এ সড়কের কারণে পানি আটকে যায় এবং সেই সময় মাঠে থাকা বোরো ধান তলিয়ে যায়। বোরো ধানের ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। আহা, আমাদের উন্নয়নের এতই দরকার! মাছ যাক, ধান যাক, পানিপ্রবাহ বন্ধ হোক কিন্তু চকচকে, ঝকঝকে সড়ক হলেই আর কোনো কথা নেই। হাওরে শুকনো মৌসুমে ধান উৎপাদনে হাইব্রিড বীজ ব্যবহার আরও বেশি আধুনিকতার পরিচয় হয়ে উঠেছে। হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করলে কীটনাশক দিতে হয়, সঙ্গে সারও ব্যবহার করা হয়। এই বিষ মাটিতে থেকে যায়। আবার যখন বর্ষার পানি আসে, তখন মাছকেও এই বিষ গিলতে হয়। মৎস্যজীবীরা তখন অসহায় হয়ে যান। বোরো ধানের আবাদ এখন বাংলাদেশের প্রধান ধানের মৌসুম হয়ে গেছে, আমন আর আউশের গুরুত্ব কমে গেছে। হাওরের বোরো ধান তাই ধানের সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা তো শুধু ভাত খাই না, মাছেরও দরকার আছে। একটির জোগান দিতে গিয়ে অন্যটির ক্ষতি করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই নিয়ন্ত্রিত কীটনাশক ব্যবহারের পরিকল্পনা করার অনুরোধ মৎস্যজীবীদের। 

ভ্রান্ত উন্নয়নচিন্তা দিয়ে উন্নতিও হবে না, জনগণের বেঁচে থাকাও কষ্টকর হবে। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন এই নতুন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই হবে।

লেখক: উপদেষ্টা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

আরও পড়ুন

×