ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

অর্থনীতির গতিপথ বদল

অর্থনীতির গতিপথ বদল

আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০৭ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৭:১২

বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘ স্বৈরশাসনের বোঝা বহন করছে। এ দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও তার গতিমুখ নির্ধারিত হয় যাদের স্বার্থে, সেই শ্রেণি গত ১৫ বছরে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের পক্ষে বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি হচ্ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতির আন্তর্জাতিক পরিচালক গোষ্ঠী বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি সব সরকারের আমলেই এক অভিন্ন গতিমুখে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল। এর মাধ্যমে তথাকথিত নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল বিভিন্ন সরকার। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সম্পদ কেন্দ্রীভবনসহ অর্থনৈতিক বৈষম্য ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে তা অনেক বেশি গতি পেয়েছে।

গত ১৫ বছরে স্বৈরশাসনের কারণে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না, জবাবদিহি ছিল না। বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন, বাছাই, প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ, বিভিন্ন চুক্তি, ব্যাংক অনুমোদন, ব্যাংকিং খাতে নিয়মাবলি নির্ধারণ– এগুলো সবই হয়েছে স্বৈরশাসনের ধরনে। এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ করেনি। এর ফলে গত ১৫ বছরে সম্পদ কেন্দ্রীভবন বেড়েছে অনেক বেশি, বৈষম্য বেড়েছে; আর্থিক খাত নৈরাজ্যে পতিত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির দিক থেকে অন্যান্য খাতের তুলনায় বেশি মাত্রায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। নদনদী, খালবিল, উন্মুক্ত স্থান সবই স্বৈরশাসনের সহযোগী বিভিন্ন গোষ্ঠীর দখলদারিত্বে পতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, যেমন– ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর অনেক প্রকল্প স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে জনসম্মতি ছাড়া, জনগণের সঙ্গে কোনোরকম পর্যালোচনা ছাড়া, সংলাপ ছাড়া এবং বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতিসহ দেশের স্বার্থ অবজ্ঞা করে। এর মধ্যে অনেক চুক্তি জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে হয়েছে, যেমন– সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী, মাতারবাড়ী, পায়রায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র; রাশিয়ার বিশাল ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র; জাপানের সঙ্গে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র; যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির সঙ্গে এলএনজি আমদানিসহ উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি। এগুলোর মধ্য দিয়ে বিদেশি কোম্পানি যেমন লাভবান হয়েছে, তেমনি একই দুর্নীতি ও অনিয়মের ধারায় দেশি কিছু কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা পেয়েছে। মাত্র ১০-১২টা কোম্পানি কোনো বিদ্যুৎ না দিয়েই লাখো কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে। এগুলোর ফলে ভুক্তভোগী জনগণ। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ১৫ বছরে ১৪ বার বেড়েছে; জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে; জাতীয় অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতগুলো অধিকতর ব্যয়নির্ভর হয়েছে, প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমেছে, উৎপাদনশীলতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

এসব তৎপরতার মধ্যেই আমরা দেখলাম, গত ১৫ বছরে কাগজপত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ভালো ছিল; কিন্তু বাস্তবে তা যথাযথ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি। এর ফলে নিয়মিত বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্বের হার। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৩০ ভাগের বেশি। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আয়তনই বেশি। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৮৫ ভাগই এই খাতে অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের কাজের কোনো নিরাপত্তা নেই; আয়ের কোনো নিরাপত্তা নেই। জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি তাদের সব সময় চাঁদাবাজ এবং পুলিশি হয়রানির মধ্যে থাকতে হয়েছে। এগুলোর কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে এবং সেটা এক পর্যায়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হয়েছে।

বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করণীয় এই ধারার পরিবর্তন ঘটানো। সরকারের সামনে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো আছে, তার মাঝে প্রধান হলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মোকাবিলা। এ সমস্যার সমাধান এখন পর্যন্ত দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। তার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর চাপ অব্যাহত আছে। এটা জনগণের মধ্যে হতাশার একটা কারণ। আর দ্বিতীয়ত, গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের যে বোঝা বেড়েছে, তাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেশি, আবার স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুতের পরিমাণ বেশি দেখা গেলেও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নেই, লোডশেডিং বেড়েছে। গ্যাসের ক্ষেত্রেও সংকট আছে। এলএনজি আমদানি, পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য ব্যয় পরিশোধ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আমদানি নির্ভরতা– এগুলোর কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

বিগত সরকারে থাকা লোকজনের লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচারের কারণে ব্যাংক রিজার্ভে যে চাপ পড়েছিল, রিজার্ভ দ্রুত কমছিল, তা থেকে বাংলাদেশ এখনও বের হতে পারেনি। এ জন্য আর্থিক খাতকে বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে; অপ্রয়োজনীয় ব্যাংক বন্ধ করা, ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী অবস্থায় নিয়ে যাওয়াই এখন বর্তমান সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান গত সরকারের আমলে দুইভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এক. বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সুরক্ষিত প্রতিষ্ঠানকে বিদেশি দুর্বৃত্ত চক্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে লাখো কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এ জন্য গত সরকার তদন্ত কমিটি করলেও তা প্রকাশ করা হয়নি। কারও জবাবদিহি বা শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব হলো এ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। কারণ, এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার জায়গায় দাঁড় করানো যাবে না। দুই. বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে আর্থিক খাতে নৈরাজ্য সমাধান করার জন্য নীতিমালা (স্বৈরশাসকের নীতিমালা) পরিবর্তন করতে পারে, সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণও একটা বড় দায়িত্বের বিষয়।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অনেক চুক্তি করা হয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয় এবং উচ্চ ব্যয়বহুল। সে জন্য আমদানিনির্ভর, বিদেশি কোম্পানিনির্ভর, ঋণনির্ভর জ্বালানি-বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা থেকে সরে এসে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে একটা টেকসই জায়গায় নিয়ে আসার প্রাথমিক কাজ এ সরকারের এখনই শুরু করা দরকার। এর সঙ্গে যেসব প্রকল্প দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর, তা বাতিল করতে হবে। যেমন– রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ এমন বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাতিল করতে হবে। আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এগুলো থাকলে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি; পাশাপাশি আর্থিক বোঝাও টানতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানির নিরপত্তা দিতে পারবে না। এর পাশাপাশি অতি উচ্চ ব্যয়বহুল যেসব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির নৈরাজ্য, দুর্নীতি, সম্পদ পাচারের তথ্য প্রকাশ পাবে। দৃঢ় জনপন্থি অবস্থান গ্রহণ করলে এই ধারা পরিবর্তনের সূচনা এই সরকার করতে পারবে। 

গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, তা তৈরির জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। যার কেন্দ্রীয় বিষয় হলো স্বৈরশাসনের রাজনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরশাসনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন করতে হবে। সেটা পরিবর্তন করতে হলে সর্বজনের জন্য বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়তে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে।

একটা কথা গুরুত্বের সঙ্গে সরকারকে মনে রাখতে বলব, গত সরকারের যে দুর্নীতি, অনিয়ম, নৈরাজ্য, সম্পদ পাচার হয়েছে; এর পাশাপাশি শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারীকরণ, রেলওয়ে ও পাট খাতে যে বিপর্যয়, এর পেছনে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির ওপর নির্ভরশীল অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন না তোলে কিংবা তা পরিবর্তনের কোনো কাঠামো তৈরি না করে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বৈরশাসক তৈরি বা সম্পদ কেন্দ্রীভবনের ভিত্তির কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। সে জন্য এসব মৌলিক বিষয় পরিবর্তনের একটা দিকনির্দেশনা এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই দিতে হবে। এটা ঠিক যে, যেহেতু অস্থায়ী সরকার, তাই তাদের অনেক কিছু করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই; কিন্তু বড় ধরনের পরিবর্তনের তারা ভিত্তি তৈরি করতে পারে। এটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়-দায়িত্ব।

লেখক: অর্থনীতিবিদ  সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি

আরও পড়ুন

×