আজকের নারী ফুটবলকে আগের সঙ্গে মেলানো যাবে না
মোসাম্মাৎ সাগরিকা
মোসাম্মাৎ সাগরিকা
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩০
গত ২৪ জুলাই ভুটানের বিপক্ষে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচে যখন মাঠে নামলাম, তখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ১ গোলে পিছিয়ে। এরপর পিছিয়ে পড়া সেই ম্যাচে আমি হ্যাটট্রিক পাই। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ জেতে ৫-১ গোলে। গত মে-জুনে চীনা তাইপের বিপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের স্কোয়াডে থাকলেও খেলার সুযোগ পাইনি আমি। ভুটানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমে আমার হ্যাটট্রিক করাটাকে অনেকে সামর্থ্যের বড় প্রমাণ হিসেবে দেখছেন। তবে আমি তা মনে করি না। সামনে আরও মনোযোগ দিয়ে খেলাটা খেলে যেতে চাই।
মনে পড়ে, ভুটানের বিপক্ষে থিম্পুর ম্যাচটি মোবাইল ফোনে দেখেছিলেন আমার বাবা লিটন আলী। ম্যাচ সম্পর্কে বাবা পরে আমাকে বলেন, প্রথমে তোকে মাঠে নামাননি কোচ। কিছুটা মন খারাপ যে হয়নি, সেটি বলব না। আগের দুটি ম্যাচেও তোকে নামানো হয়নি। তবে পরে নেমেও যে তুই ৩ গোল করলি। দেশ জিতল। আমরা সবাই আগের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেছি। খুব খুশি হয়েছি।
বছর তো এখন শেষ হতে চললো। মনে পড়ে, এই বছরের শুরুর দিকের ৮ ফেব্রুয়ারির কথা। কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় ভারতের। ম্যাচে আফঈদা, স্বর্ণা, স্বপ্না, পূজা, উমহেলা, ইতিসহ আমরা লড়ি বয়সভিত্তিক ফুটবলে সাফ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে। বাংলাদেশ এই ফাইনালে আসে আমার করা গোলেই! ফাইনাল নির্ধারণী ম্যাচের ৯১ মিনিটে অধিনায়ক আফঈদার লম্বা থ্রু ধরে গোল করি আমি। আর অমনি স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়ে। প্রথম ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয়েও আমি দুটি গোল করেছিলাম। চার দলের টুর্নামেন্টে চার গোল করে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছি আমি। কেবল তা-ই নয়, সবাইকে ছাপিয়ে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও নিজের ঝুলিতে পুরেছিলাম। অথচ আপনারা জানলে অবাকই হবেন যে, আমার ফুটবলই খেলার কথা ছিল না। বাবা-মা এক সময় করেছেন আমার ফুটবল খেলার তীব্র বিরোধিতা।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে। বাবা লিটন আলী আর মা আনজু বেগম। বাবার চা বিক্রির টাকায় সংসার চালানো আমাদের পরিবারে অভাব-অনটন যেন নিত্যসঙ্গী। এরমধ্যে আমি খেলতে চাই ফুটবল। সমাজের কটু কথার ভয়ে আমাকে ফুটবল খেলতে বারণ করতেন বাবা। কিন্তু আমার আগ্রহ আর জেদের কাছে হেরে যান তিনি। আমি ভালো খেলার পর বাবা একদিন বলেন, আমি আমার মেয়েকে খেলতে দিতে চাইনি। আমরা যে পরিবার, তাতে ফুটবল খেলা একটা বিলাসিতাই মনে হয়েছিল। তা ছাড়া আমার একটা শঙ্কা ছিল, ফুটবল খেললে সবাই কী বলবে! মেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম। মেয়ে এখন শুধু আমাদের নয়, পুরো দেশের। আমার মেয়ে দেশের হয়ে খেলছে– এই গর্ব আমি কোথায় রাখি!
আমার ফুটবল খেলার প্রথম পাঠ রাণীশংকৈলের রাঙ্গাটুঙ্গি একাডেমিতে। এই একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাঙ্গাটুঙ্গি একাডেমি থেকে কয়েকজন মেয়েকে ভর্তি নিতে চেয়েছিল বিকেএসপি। আমি সেখানে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। পরে তাজুল ইসলাম স্যারই আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। আমি তখন থাকতে না চাওয়ায় গ্রামে নিয়ে আসেন তাজুল ইসলাম স্যার। এরপর রাঙ্গাটুঙ্গি থেকেই আমি অন্য ফুটবলারদের সঙ্গে মেয়েদের ফুটবল লিগের দল এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে খেলি।
মেয়েদের লিগে আমি পাল্লা দিয়েছি দেশের শীর্ষ নারী ফুটবলারদের সঙ্গে। সেবার ২৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন আকলিমা আক্তার। আমি গোল করেছিলাম ১০টি। এরপরই মেয়েদের ফুটবলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন আমাকে নিয়ে আসেন মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলে। বাফুফের ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে খেলতে গ্রাম ছাড়ার পর গ্রামবাসী রটিয়ে দেয়, প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে সাগরিকা! এতে একটু নড়েচড়ে বসে পরিবার। তবে এই কটু কথা থেকে সাহস খুঁজে পাই আমি!
আমার খেলা মাঠে বসে দেখতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল থেকে ট্রেনে চড়ে ঢাকায় এসেছিলেন বাবা-মা। অনেক লম্বা পথ। ট্রেনে বসার জায়গা না পাওয়ায় সেই যাত্রা আরও দীর্ঘ হয়ে ওঠে তাদের কাছে। এর ওপর মা আনজু বেগম একটু অসুস্থও ছিলেন। এক সহযাত্রীকে অনুরোধ করে চালের বস্তার ওপর একটু বসার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে রক্ষা! অনেক ঝক্কি-ঝামেলা শেষে কমলাপুর স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে এসে বসলেন বাবা লিটন আলী ও মা আনজু বেগম। মাঠে খেলা চলছে। ফ্লাডলাইটের আলো আর ক্যামেরার লেন্সে চোখের জল চিকচিক করছিল বাবা-মায়ের। আমি যেন তা চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছিলাম। আরও দেখছি, মায়ের চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি। তবে এ কান্না শোকের নয়, মেয়ের অর্জনে আনন্দের। অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার মা খেলা শেষে বলেছিলেন, ‘ফুটবল খেলার জন্য আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করেছে, সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সে ফুটবল খেলেছে। তবে তার জেদ ছিল, সে ফুটবলার হবেই। তাকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি। আমাদের কাছে একজোড়া বুট চেয়েছিল, বুটের অনেক দাম, তাই তাকে বুটও কিনে দিতে পারিনি।’
গতি, শটের পাওয়ার ও গোল করার দক্ষতা দেখে অনেকে আমাকে জাতীয় দলের অধিনায়ক সাবিনা আপুর ছায়া বলেন। অবশ্য আমাদের দু’জনের পজিশনও প্রায় একই। যদিও সাবিনা আপুর জায়গায় যেতে পারব না। তারপরও চেষ্টা করব। আপুর খেলা আর আমার খেলা তো এক না। তিনি অনেক সিনিয়র। তাঁর জ্ঞান ও আমার জ্ঞান আলাদা।
ওই জায়গায় যেতে আমার অনেক পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রম করেই আমি আরও এগোতে চাই। ফুটবলে আসার আগে আমাকে কেউ চিনত না। এখন অনেকে চেনে। এতে আমার দায়িত্ব যেন আরও বেড়ে গেছে। এজন্য আগামীতে আরও বেশি ভালো খেলে জায়গা তৈরি করতে চাই।
আর আগে যারা নারী ফুটবলকে গুরুত্ব দিতেন না, কটু কথা বলতেন, এখন তারা আমাদের ফোন দিচ্ছেন, কোচকে ফোন দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। অনেক কিছুই বদলাচ্ছে। আজকের নারী ফুটবলকে আগের সঙ্গে মেলানো যাবে না। অসম্ভব উন্নতি করেছেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। খেলোয়াড়দের মধ্যে যেমন পেশাদারিত্ব গড়ে উঠেছে, তেমনি তাদের গতি ও স্কিল ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এখন পুরো ৯০ মিনিট আমাদের নারী ফুটবলাররা মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে পারেন।
তবে আরও বড় অর্জনের জন্য এখনও অনেক দূর যাওয়া বাকি। আমরা যদি লক্ষ্যটা সাফ পর্যন্ত না রেখে আরও বড় করি, তাহলে আমাদের নারী ফুটবলের ট্রেনিং ও টেকনিক্যাল সুযোগ-সুবিধা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি অবকাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পেশাদার ক্লাব ফুটবলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। মেয়েরা আর্থিকভাবে লাভবান হলে, যথাযথ সম্মান পেলে পরিবার ও সমাজে এর প্রভাব পড়বে নিশ্চিতভাবেই। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলে তা শুধু নারী ফুটবলের ক্ষেত্রেই নয়, মেয়েদের অন্যান্য খেলায় এগিয়ে আসার পথও সুগম করবে।
দলে আমরা অনেকেই আছি, যারা ফুটবল খেলার নিয়ম-নীতি কিছুই বুঝতাম না, যখন খেলাটা শুরু করি। ছোট একটা বয়স থেকেই আমরা এটুকু বুঝতে পারি, এ খেলাটাই আমাদের জীবনে সুদিনের দেখা দিতে পারে। ফুটবল ঘিরেই আবেগ-অনুভূতি। খেলার প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকেই ফিটনেস ধরে রেখে দীর্ঘদিন খেলে যেতে চাই।
সমকাল আগে থেকেই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে খেলাধুলায় নারীর পথচলাকে এগিয়ে নিতে আরও বেশি কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে!
ফুটবলার
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল
- বিষয় :
- ফুটবল