হলিউডে আমাদের তারুণ্য

আফসারা তাসনীম আলভী
আফসারা তাসনীম আলভী
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৯
গত ৭ জুন বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছে হলিউডের আলোচিত সিনেমা ‘ব্যাড বয়েজ রাইড অর ডাই’। এতে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি আমি। আমার কাছে একসময় এটি স্বপ্নের মতোই ছিল। হলিউডে আমার এ স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালে। স্নাতক শেষ করেই শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করি সনির ‘ফাদারহুড’-এ। এর মধ্যে টিভি সিরিজ ‘ওবি-ওয়ান কেনোবি’তেও কাজ করেছি। ‘দ্য মাপেটস মেইহেম’, ‘গাইস গ্রোসারি গেমস’, ‘টুর্নামেন্ট অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ ও ‘স্টার ওয়ারস’-এর চরিত্র নিয়ে কাজ করেছি। এ ছাড়াও ‘রিভেঞ্জ অব দ্য সি’তে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ‘ব্যাড বয়েজ রাইড অর ডাই’-এর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০২৪ সালের মে মাসে এসে।
হলিউডে এমন সব লোকের সঙ্গে কাজ করেছি এবং করছি, যা আমার কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। আমি পুরো পোস্ট-প্রডাকশন টিমে কাজ করেছি। দু’জন মূল এডিটর ছিলেন ‘ব্যাড বয়েজ রাইড অর ডাই’-এ। তারা হচ্ছেন ড্যান লেবেন্টাল ও আসাফ ইসারবার্গ। আমরা পাঁচজন অ্যাসিস্ট করেছি। ড্যান লেবেন্টাল একজন লিজেন্ডারি এডিটর। তিনি ‘আয়রনম্যান’ থেকে ‘স্পাইডারম্যান’ এডিট করেছেন। ড্যান লেবেন্টালের সঙ্গে কাজ করেছি মানে তাঁর কাজ দেখে শিখেছি আমরা। সপ্তাহের টানা সাত দিন কাজ করেছি সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। একেকটি দৃশ্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। এ জন্য যে, কীভাবে উপস্থাপন করলে দর্শক সেটি উপভোগ করবে। কীভাবে গল্পটিকে আরও ফুটিয়ে তোলা যায়।
বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা অন্য আট-দশজনের মতো ছোটবেলায় পরিবার থেকেই সিনেমার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। মায়ের পাশে বসে দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবি। তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’। মা হলে নিয়ে দেখিয়েছিলেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’র মতো সিনেমা। ছোটবেলায় যে ভালোবাসা তৈরি হয় সিনেমার প্রতি, সেই ভালোবাসার বিষয়টিই এখন পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার। আমার জন্ম খুলনায়। দাদুবাড়িতে। দাদা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাই দাদাকে দেখা হয়নি আমার। তবে বড্ড আদুরে ছিলাম দাদির। শৈশবে বড্ড চঞ্চল ছিলাম। আমার দুষ্টুমির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যেতেন মা! তবে শৈশবের বড় একটা সময় কেটেছে যশোরে, নানাবাড়িতে। সেখানেও ছিল আমার দুরন্তপনা। একটু মাথা তোলা হতেই আমাকে ভর্তি করানো হয় খুলনার এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুলে। মাধ্যমিকে ভর্তি হই যশোর বিএএফ শাহীন স্কুলে অ্যান্ড কলেজে। এখান থেকেই স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে মায়ের হাত ধরে পাড়ি জমাই যুক্তরাষ্ট্রে।
আমার বাবা মেসবাহুল হাসান একজন ব্যবসায়ী। তিনি দেশেই থাকেন। মা আফরিনা পারভীন অ্যানিম্যাল টেকনিশিয়ান। ২০১৩ সালে পাড়ি জমাই যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাংকার হিল কলেজে ভর্তি হই। কিছুদিন পর আবেদন করি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউম্যাস বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় ও এমারসন কলেজে। আগে ডাক আসে বোস্টন থেকে। সেখানে ভর্তি হই পছন্দের বিষয় মিডিয়া আর্টস প্রডাকশনে। এর মধ্যেই ডাক আসে এমারসন কলেজ থেকে। তাই ডাক পেয়ে বোস্টনের ভর্তি বাতিল করে ছুটে যাই এমারসনে। ২০১৫ সালে প্রিয় এমারসন কলেজে ভর্তি হই পছন্দের বিষয় মিডিয়া আর্টস প্রডাকশনে।
২০১৯ সালের কথা। তখনও স্নাতক শেষ হয়নি। এর মধ্যেই শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়ে যাই সনিতে। কিছুদিন পর স্নাতক শেষ হতেই প্রস্তাব পাই ‘ফাদারহুড’-এ পোস্ট-প্রডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার। নিজের সবটুকু দিয়ে কাজ করতে থাকি। কাজে আমার দায়িত্বশীলতা, সৃজনশীলতা, দক্ষতা এবং একাগ্রতা দেখে পরের বছর আমাকে দেওয়া হয় আরও বড় সুযোগ। নিজের পছন্দের এবং বিশ্ববিখ্যাত চিত্র সম্পাদক পিয়েত্র স্কেলিয়ার সঙ্গে কাজ করতে দেওয়া হয় আমাকে। এই পিয়েত্রের মায়াবী হাতে তৈরি হয় ‘জেএফকে’, ‘লিটল বুদ্ধা’, ‘গ্ল্যাডিয়েটর’, ‘আমেরিকান গ্যাংস্টার’, ‘দি অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান’, ‘দ্য মার্শিয়ান’, ‘সলো: এ স্টার ওয়ারস স্টোরি’র মতো বিশ্ববিখ্যাত সব ছবি। নিজের প্রিয় চিত্র সম্পাদক চোখের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, কাজ করছেন– এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। তাঁর সঙ্গে সনির স্পাইডারম্যান ইউনিভার্সের ছবিতে কাজ করছি; এটা আমার কাছে স্বপ্নের মতোই।
দেখতে ভালোই লাগে যে, হলিউডে এখন আমি একা নই। আমার মতো অসংখ্য তরুণ এখানে কাজ করছে খুব দাপটের সঙ্গে। এই তরুণদের জন্য গর্ব হয়। আমি এই তরুণদের দলেরই একজন মাত্র। তবে এখানেই থামতে চাই না। আগামীতে আরও বড় সিনেমায় কাজ করতে চাই এডিটর হিসেবে। আমার চাকরি যেমন দুটি, তেমনি স্বপ্নও দুটি। চিত্র সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে চাই মার্বেলে। তাও স্পাইডারম্যানের ছবিতে। সেটি পাঁচ বছর পর হোক কিংবা দশ বছর পর। এছাড়া কোস্টাল এরিয়াতে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর সাসটেইনেবল কিছু করতে চাই। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও তরুণদের শিক্ষার উন্নয়নেও কাজ করছি এবং আগামীতেও করতে চাই। কিছুদিন আগে দেশে গিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছি। আসলে এসব বলার জন্য যাইনি। গিয়েছি মানবিক জায়গা থেকে। সেসব জায়গায় গিয়ে দেখেছি মানুষের কষ্ট এবং একই সঙ্গে মানুষের মানবিকতা। বাংলাদেশের মানুষ; বিশেষ করে তরুণরা চাইলে সবই পারে; তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ নিজের চোখে দেখে এসেছি। আর জুলাই আন্দোলন তো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তরুণদের গণজোয়ার এবং শক্তিমত্তা দেখিয়ে দিয়েছে। আমি দ্বীপ এলাকার তরুণদের জন্য কাজ করছি। গড়ে তুলেছি কান্ডারি নামের সংগঠন। সেখানে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে লার্নিং প্রোগ্রাম করছি। কারণ, তরুণরা বদলালেই বদলে যাবে সমাজ, বদলে যাবে দেশ। এই তরুণরাই আমাদের আগামীর কান্ডারি! পরিশেষে, সমকালের তরুণদের আয়োজন ‘সাহস’সহ পত্রিকার সব সাংবাদিক ও কলাকুশলীকে অভিনন্দন জানাই। ২০ বছরে পদার্পণ করেছে সমকাল। এই দীর্ঘ সময় একটি গণমাধ্যম স্বমহিমায় মাথা তুলে আছে। তরুণদের সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতেও তরুণদের পথচলাকে এগিয়ে নিতে আরও বেশি কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে দেশের শীর্ষস্থানীয় এ পত্রিকা।
হলিউডের ‘ব্যাড বয়েজ রাইড অর ডাই’সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রের সহকারী সম্পাদক
- বিষয় :
- তারুণ্য