গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত

আজাদ আবুল কালাম
আজাদ আবুল কালাম
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪০
‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই আল্লাহ...’
ওমা মেঘ না চাইতেই যেন বৃষ্টি– জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার বিপুল উত্থান এবং গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের উৎখাত জাতির জন্য এক বিজয় চিহ্ন।
৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন যাত্রা বাংলাদেশের; যার মূলমন্ত্র বৈষম্যহীন স্বাধীন আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়।
১০ আগস্ট বেলজিয়ামপ্রবাসী এক স্কুলবন্ধু কল্লোল তিন সপ্তাহের ছুটিতে দেশে এসেছে সাত বছর পর। শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী এবং দু’সন্তানের জনক কল্লোল শত ব্যস্ততার মধ্যে দেশের খবর আমাদের চেয়ে ভালো রাখে; কখনও সখনও আমার অগোচরের ঘটনাপ্রবাহের সংবাদ বা নানান বয়ান ব্যাখ্যা অবহিত করে গেছে বছরের পর বছর। ঢাকায় মধুবাগের বাসায় ঢুকেই বেরিয়ে পড়ে ঢাকার পথেঘাটে, সঙ্গী কেবল আমি আর মধুবাগেরই এক রিকশাচালকের সঙ্গে কল্লোলের দিনকাবারি চুক্তি। কল্লোলকে ঘুরে ঘুরে দেখাই ঢাকা আর পরিবর্তিত দেয়াল গ্রাফিতি।
উচ্ছ্বাসে সে আত্মহারা, আবার যখন দেখে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া কোনো ইমারত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনো স্থাপনা তার চোখে পড়ে, তখন সে শঙ্কিত হয়, মুখ মলিন হয়। যেমনটি দেখেছি তার ভিডিও কলে আবেগ আর অশ্রুসজল চোখ, জুলাই-আগস্টের দিনগুলোতে শহীদ আবু সাঈদ থেকে শুরু করে অগুনতি মানুষের আত্মদানের মিছিল কল্লোলকে বিচলিত করেছে, যেন পারলে তখনই দেশে উড়ে আসে।
কল্লোল, আমি প্রায় প্রতিদিন আগের পাড়ামহল্লায়, আড্ডার নির্ধারিত চায়ের দোকান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ইত্যাদি ঘুরি। বন্ধু আমার জ্ঞানী, তার মুখে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের তুবড়ি ফোটে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যায়– ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী অবস্থা, রাশিয়ার বিপ্লব-পরবর্তী অবস্থা, আরব বসন্ত, শ্রীলঙ্কার পট পরিবর্তনের বিচিত্র ছবি, এমনকি সিরিয়ার বিদ্রোহী আর সরকারের চলমান যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-লেবানন-ইসরায়েল যুদ্ধ সবই। সেই কলেজজীবন থেকে সে একটু বেশি মাত্রায় রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ থেকেছে, বাম দলগুলোর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকলেও সেই বয়সেই নিজ বিশ্লেষণে সব প্রত্যাখ্যান করায় কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তার সংযুক্তি ঘটেনি। কিছুদিন শুধু গণতন্ত্রী পার্টির অফিসে যাতায়াত করেছে অনিয়মিত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে হঠাৎ আরও কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে এক নতুন সম্ভাবনার জীবন প্রত্যাশায় বেলজিয়ামের উদ্দেশে দেশ ছাড়ে, কিন্তু দেশ তাকে ছাড়েনি। ভাইবোনের বিয়ে কিংবা মা-বাবার অসুস্থতা ইত্যাদি এমনকি কখনও তুচ্ছ কারণকে বড় করে স্ত্রীর অনুমতিসাপেক্ষে দেশে এসেছে। একবার শুধু বিবি-বাচ্চাদের নিয়ে দেশে এসেছিল শীতে। ধুলার রাজ্যে হাঁসফাঁস স্ত্রী-সন্তানেরা এক সপ্তাহের মধ্যে চিরতরে বাংলাদেশ বিমুখ হয়েছে।
তিন সপ্তাহ দেখতে দেখতে শেষ হয়। আর কল্লোল কেমন বোকা বোকা হতাশ কথা বলতে থাকে। যাওয়ার দিন কথা হয়–
কল্লোল: কী বুঝছস?
আমি: তুই কী বুঝছস?
কল্লোল: বুঝি না, তবে অনেক পাল্টায় গেলো দেশটা।
আমি: হ, এক মাসের মধ্যেই সব চাস? দেশ তো ফোকলা।
কল্লোল: আচ্ছা তোরা কী কামকাজ করতে পারবি? মানে তগো নাটক-ফাটক সংস্কৃতি এসব আরকি?
আমি: না পারার কী আছে। আগে কি খুব মধু আছিলো? করছি না।
কল্লোল: ছয় মাস পর আবার আমু।
কল্লোলপর্ব আপাতত শেষ হলেও ওর “কী বুঝছস” আমাকে ভাবিত করে।
আদতেই ছাত্র-জনতার উত্থান এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক অস্থির সময় পার করেছে বাংলাদেশ। প্রতিদিন নতুন সম্ভাবনার আশা জাগছে, তেমনি হঠাৎ বন্যা, নানান নতুন হট্টগোল, আর নিজ চিন্তা বা বিশ্বাসের ঝান্ডা তুলে ধরতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি জুলাই-আগস্টের গণআকাঙ্ক্ষার কথা, যা রাজপথ রক্তে রাঙিয়ে দেয়ালে দেয়ালে তরুণের চাওয়া-পাওয়ার গ্রাফিতি। এমন নৈরাজ্য যদি প্রাত্যহিক হয়ে যায়, তাহলে সমাজ এক অজানা শঙ্কা, আতঙ্কে দিনাতিপাত করবে। ফ্যাসিস্ট যখন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সরে পড়ে, তখন তার কর্মের ছায়া সঙ্গে করে নিয়ে যায় না, বরং রেখে যায় প্রদর্শনীর মতো করে, যার প্রত্যক্ষণ এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। ভাবা হতো, দেখা হতো, গণতন্ত্রহীনতা, মতপ্রকাশের বাধা, আইনবহির্ভূত অন্যায়, খুন-গুম, দুর্বৃত্তায়ন স্পষ্ট অর্থবাণিজ্য ক্ষেত্রে, পশ্চিমের শহরে সুরম্য অট্টালিকার পাক্কা দ্বিতীয় বন্দোবস্ত। সব জেনেশুনে যেন কিছুই করার নেই, কোনো আন্দোলন দাড়াচ্ছে না, কিছুই যেন করার নেই, এমন এক হালছাড়া হতাশা, ঠিক তখনই একটা ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণ যেন দমবন্ধ করা আবহাওয়ার সমাপ্তি হয়। আমরা এক মুক্ত নতুন স্বদেশের প্রত্যাশী হয়ে ওঠি। এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে থাকি, যেখানে কারও রক্তচোখ ইঙ্গিতে ভয় দেখাবে না, বাধা হয়ে দাঁড়াবে না মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার পথে। একই বন্দনা সংগীত হবে না আমাদের অর্কেস্ট্রা। মুক্তপ্রাণের সাংস্কৃতিক জাগরণ হবে শহরে-বন্দরে, গ্রামে, পাহাড়ে, সমতলে। দীর্ঘদিনের চেপে রাখা মুক্তমনের সৃজন উন্মাদনায় দেশ খুশিতে নাচে।
কিন্তু নাচেনি, বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি সংকুচিত অবয়ব। বিভিন্ন জেলায় শিল্পকলা একাডেমি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, আখড়াকেন্দ্রিক সংগীত চর্চা হুমকিতে, ধমকে কুণ্ঠিত বাউল-ফকির। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছুর আরোপিত ব্যাখ্যা এবং অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। এইসব যত দ্রুত প্রকাশ হচ্ছে, ততটা দমানোর বা থামানোর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম এক বৃহত্তর একত্রীকরণ প্রক্রিয়ার (ইনক্লুসিভ) প্রারম্ভ হবে ’২৪-এর চেতনা। বহুত্ববাদের নিঃসঙ্গ প্রকাশই হবে নতুন চিন্তার শক্তি।
দেয়ালে দেয়ালে দেখি “আমি ৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি,’’ তাহলে ’৭১ কোথায় গেল? লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তার লাল-সবুজের পতাকাই তো এখন তরুণের মস্তকে শোভা পায়। সংস্কৃতির বড় অনুপ্রেরণা তো ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসের নতুন বয়ান তো সত্যকে মুছে দেবে না। নতুন কোনো বয়ান চাপিয়ে দেওয়া মানে নতুন কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম দিতে পারে। ফ্যাসিবাদ বলে শত্রু খুঁজতে খুঁজতে আমরা যদি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে থাকি, আপাতপ্রাপ্ত ক্ষমতার অতি ব্যবহার কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করবে, যা প্রকারান্তরেই ফ্যাসিবাদ।
নির্যাতিত মানুষও নির্যাতকের ভূমিকায় নামতে পারে আরও প্রবলভাবে। পৃথিবীজুড়ে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ইহুদিরা নিগৃহীত হয়েছে, আবার ‘প্রতিশ্রুত’ নিজস্ব ভূমির মালিক হয়ে অর্থ প্রতিপত্তি, জ্ঞান, বাণিজ্যে উৎকর্ষ লাভ করেছে। তারাই এখন বড় নির্যাতকের ভূমিকায়। গাজা-বৈরুতের মানুষের হত্যার মিছিল যেন তাদের বিধ্বংসী উল্লাস। সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য দরকার উন্মুক্ত পরিবেশ এবং রাষ্ট্র, করপোরেট আর জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা। যখন মতপ্রকাশে বাধা আসে তখন সংস্কৃতি পথভ্রষ্ট হয় এবং বিশৃঙ্খল অথবা তোষামোদে প্রকাশের আশ্রয় নেয়। বহুমত প্রকাশের ঝুঁকির মধ্যে আমরা আছি। গত ১ ডিসেম্বর সিপিডির ৩০ বছরের পূর্তিতে তাদের অভিমত একই কথা বলে।
সংস্কৃতিকর্মীরা সাহসী, তবে তা তাদের সৃজন প্রকাশে। রাস্তায় দাবি নিয়ে সে নামে বটে কিন্তু তার মূল কাজ অন্তর জগৎকেন্দ্রিক এক নিমগ্ন সাধনা। সেই নিমগ্নতায় কারও নির্দেশিকা বা নির্দিষ্ট তত্ত্ব তথ্য চাপিয়ে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। ’২৪-এর অভ্যুত্থানের দেয়াল লিখন শুধু দেয়ালেই থেকে যাবে, জাতি এক কাতারে দাঁড়াতে পারবে না। এই মাত্র আর একটা হোয়াটসঅ্যাপে কল কল্লোলের। সে-ই এখন আমার বন্ধু, মেন্টর, গাইড।
কল্লোল: কী রে, কী খবর? বুঝছস কিছু?
আমি: তুই কি বুঝছস?
কল্লোল: ভালো ঠেকে না। আমি আমু মার্চে ২৫-এ। তখন যদি বুঝি কমুনে তরে।
আমার ডেটা শেষ হয়ে যায়।
অভিনেতা
নাট্য পরিচালক
- বিষয় :
- গণঅভ্যুত্থান