চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস

বাবর আলী
বাবর আলী
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪২
‘হার মেনেছে, হার মেনেছে হিমালয়ের চূড়া/মুখে মুখে হাসির ঝিলিক, ছেলে কিংবা বুড়া।’ আমার পরম সৌভাগ্য যে, আলেক্স আলিম আমাকে নিয়ে এমন একটি ছড়া লিখেছেন। আসলে ১১ বছর পর ফের ২০২৪ সালে লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে। কেবল এভারেস্টই নয়; প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে লোৎসেও জয় করতে পেরেছি আমি। আসলে আমার বয়স এখন ৩৩। পেশায় ডাক্তার। কিন্তু নেশায় আমি পর্বতপ্রেমী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকেই পাস করেছি এমবিবিএস। চিকিৎসা পেশা শুরু করলেও মন বসেনি সেখানে। তাই চাকরি ছেড়ে দেশ-বিদেশ ঘোরার কর্মযজ্ঞ শুরু করি। সেই শুরুর এক সুন্দর ও গৌরবময় সমাপ্তিও টেনেছি। ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছি এভারেস্টের চূড়া। আর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে একসঙ্গে জয় করেছি লোৎসেও।
আমার এভারেস্ট অভিযান ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। মিশন শুরু করি ১ এপ্রিল। ১০ এপ্রিল এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে পৌঁছাই। ২৬ এপ্রিল বেস ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে এভারেস্ট ক্যাম্প-২ এ পৌঁছলেও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় ফিরে আসি। তার পর এভারেস্টের চূড়ায় উঠার মতো উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে। ফের যাত্রা শুরু করি গত ১৪ মে। এদিন উঠি দ্বিতীয় ক্যাম্পে, ১৮ মে তৃতীয় ক্যাম্পে এবং ১৯ মে ভোরে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছাই। ১৯ মে ভোরে ডেথ জোন নামে পরিচিত শৃঙ্গে আরোহণ করি। একই দিন বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করি। দুই বছর আগে হিমালয়ের ২২ হাজার ৩৪৯ ফুট উচ্চতার আমা দাবলাম চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম। এবার ছুঁলাম এভারেস্ট। ১৯ মে আমি এভারেস্ট জয় করে নিচে নামি। এর মাধ্যমেই শেষ হয় আমার প্রায় দুই মাসের অভিযান। ২১ মে চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘লোৎসে’ জয় করে এই আনন্দকে দ্বিগুণ করে তুলি।
আসলে বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা অনেকের স্বপ্ন। প্রতিবছর হাজারো পর্বতারোহী এভারেস্টের পথে হাঁটেন। কিন্তু এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পর একই সঙ্গে আরেক পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে ওঠার চেষ্টা অনেকেই করেন না। বাংলাদেশ থেকে আগে কেউ এমন চেষ্টা করেননি। আমি সুযোগ পেলে সেই চ্যালেঞ্জও নিয়েছি। অর্থাৎ একই অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট ও চতুর্থ উচ্চতম পর্বত মাউন্ট লোৎসের চূড়ায় উঠি। এভারেস্টের সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতার লোৎসেও শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করি। যেখানে এখন পর্যন্ত পদচিহ্ন পড়েনি কোনো বাংলাদেশির।
এই অভিযান হুট করে শুরু করিনি। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। এভারেস্ট জয়ের আগে আরও অনেক পর্বতশৃঙ্গ জয় করি। ৪ হাজার ৯৮৪ মিটার উচ্চতার সারগো রি থেকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট আমা দাবলামসহ অন্তত ৯টি পর্বতশৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড আছে আমার ভান্ডারে। এসব অর্জনে পাওয়া পদক শোভা পাচ্ছে আমার বাসার দেয়ালে। আমার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী। শহরের সঙ্গে লাগোয়া এই উপজেলার বুড়িশ্চর গ্রামের নজু মিয়া হাট এলাকায়। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। বড় ভাই ব্যারিস্টার, থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। আমার নম্বর দুই। বাবা লিয়াকত আলী কুয়েতপ্রবাসী। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। মা লুৎফুন্নাহার বেগম গৃহিণী।
আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে এভারেস্ট জয়ের পর মানুষের ভালোবাসা পেয়ে। আমার মা সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছেলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, এভারেস্ট জয় করবে। সে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। চিকিৎসক হিসেবে পেশা শুরু করলেও তার নেশা ছিল ভ্রমণ। ছেলে এভারেস্টে যাবে এ জন্য মা হিসেবে বুকের ভেতরে ভয় কাজ করলেও সাহস রেখেছি।’ একজন সন্তানের জন্য এটি অনেক বড় অনুপ্রেরণা। আমি এভারেস্টের চূড়ায় ঠিকঠাক যেন উঠতে ও নেমে আসতে পারি, এ জন্য মা জায়নামাজে বসে দোয়া করেছেন।
এভারেস্টের উচ্চতা বেশি হলেও লোৎসে আরোহণ আমাকে বেশি আনন্দ দিয়েছে। সুস্থ শরীরে ফিরে আসতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য অনেক বড় কিছু। ওখান থেকে নামার পরও দেশে আসার পর অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, আমার হাতে বা পায়ে কিছু হয়েছে কিনা। আমি এখনও সুস্থ আছি। কাঠমান্ডুতে আমি ৮ কিলোমিটার রাস্তা দৌড়ে এভারেস্ট জয়ের আনন্দ উদযাপন করেছি। দেশে ফেরার পর নগরীর চকবাজারে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এভারেস্ট জয়ের গল্প শোনাই তরুণদের। আসলে মানুষের একটি সুপ্ত বাসনা থাকে সর্বোচ্চ উঁচু জায়গা থেকে পৃথিবীকে নিজের চোখ দিয়ে দেখার। এভারেস্টের চূড়ায় আমি এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ছিলাম। তিব্বতের সাইড দেখে খুব ভালো লেগেছে। এভারেস্ট জয়ের পর নেমে আসার সময় তুষার ঝড়ে দেড় ঘণ্টা আটকে ছিলাম। পরে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ক্যাম্পে নেমে আসতে পেরেছি। তবে এভারেস্টে জয় করার আগে আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থ। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এমন অভিযান পরিচালনা করা খুব কঠিন। এবারই প্রথম আমি স্পন্সর ও মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কোনো মাউন্ট অভিযানে গিয়েছি। এর আগে যতগুলো অভিযান করেছি, সব নিজের টাকায় করেছি। এবার সবার সহযোগিতা পেয়েছি বলেই এভারেস্ট জয় করতে পেরেছি। এর পর অনেক টেকনিক্যাল মাউন্ট আছে সেগুলোতে যাব।
ডাক্তারি ছাড়া তো আর কিছু পারি না। তাই চাকরি নিতে হবে। সঞ্চয় দিয়ে পর্বতারোহণের নেশা পূরণ করতাম। এভারেস্ট জয় করার চেয়ে কঠিন এর জন্য তহবিল জোগাড় করা, পৃষ্ঠপোষক পাওয়া। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের অনেক তরুণ এভারেস্ট জয় করতে পারবে। আমার পর্বতারোহণ অভিযানে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার মতো। যার একটি বড় পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে আমিই প্রথম যিনি ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে এভারেস্ট জয় করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রতিটি ঘরে ঘরে বাবর আলী জন্ম নেবে। ক্রাউডফান্ডিংয়ে আমি ২৫ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পেয়েছি। তাই বলি, আমি একা এভারেস্টে উঠিনি। যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আমার পাশে থেকে সাহস দিয়েছেন সবাইকে নিয়েই আমি এভারেস্টের চূড়া জয় করেছি।
আমার আগে আরও পাঁচজন এভারেস্ট জয় করেন। ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। ২০১১ ও ২০১২ সালে দু’বার এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট। ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্ট জয় করে নামার পথে মারা যান সজল খালেদ, যিনি পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে পর্বতজয় করেছিলেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর গত ১১ বছরে আর কোনো বাংলাদেশি এভারেস্টের পথ মাড়াননি। ১১ বছর পর আমার হাত ধরে আবার লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে এভারেস্টের বুকে। ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ের এ অভিযানে সাধারণ মানুষ ছাড়াও আমার পাশে দাঁড়ায় ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেড, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ব্লু জে, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী, গিরি, ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। এত এত মানুষের ভালোবাসা নিয়ে আগামীতে এমন অনেক পাহাড় আছে যেগুলোতে এখনও কেউ যায়নি, সেগুলোতে যেতে চাই আমি। নেপালের অন্নপূর্ণা মাউন্টে যাব সামনে। আর এটা বিশ্বাস করি, ১১ বছর পর আমি যে পথে গিয়েছি, দেশের তরুরণরা সে পথে তাদের সাহসিকতার পা বাড়বে রুটিন করেই! বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে গাইবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গান– আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
এভারেস্ট ও প্রথম বাংলাদেশি
হিসেবে লোৎসেজয়ী
- বিষয় :
- গল্প