ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দীপ্তপ্রাণ

প্রজন্মের পথচলা

প্রজন্মের পথচলা

তারিক আনাম খান

তারিক আনাম খান

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৪

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবিতাটি প্রেরণাদায়ক। তারুণ্য সবসময় প্রতিবাদী– অসত‍্য অন‍্যায় বৈষম্য ও অমঙ্গলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধীসহ প্রগতিশীল সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা এই তারুণ্যের। কবির এই আকাঙ্ক্ষা যৌবনের স্বর্ণালি দিনগুলোকে সূচারুরূপে পরিচালিত করার। আমাদের তরুণরা এক অভাবনীয় জাগরণ ঘটিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ছাত্রদের আন্দোলন কখনো পরাজিত হয়নি। এখন নতুন করে এগিয়ে যাবার, নতুন করে দেখার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। 
তবে এ মুহূর্তে এক ধরনের অস্থিরতা আছে। দেশের পরিস্থিতি অস্থির হলে সংস্কৃতিক অঙ্গন গুটিয়ে যায়। জুলাইয়ের আগেও টেলিভিশন অঙ্গনে স্থবিরতা চলছিল, জুলাইয়ের পর তা আরও গভীর হয়েছে। সিনেমা হলের ব্যবসায়ও মন্দা ছিল। মঞ্চের কাজেও এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছিল বহুদিন ধরে। তবে চলছিল কোনো রকমে। যে কোনো সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু এলোমেলো হলেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ৫ আগস্টের পরই আমরা সব বন্ধ্যত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি বা কাটিয়ে উঠেছি তেমনটা মনে হয় না। তবে কোথায় যেন একটা আলোর আভাস দেখা যায়। এখন একটু একটু করে স্থবিরতা কাটছে।
সংস্কৃতি হচ্ছে একটি দেশ ও জাতির বড় পরিচয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় বিষয়। এর সঙ্গে তার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষা জড়িত। বাংলাদেশ নামের দেশটি পৃথিবীতে অনন্য, কেননা আমরা ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে সংগ্রাম করেছি। আমাদের স্বাধীনতার চাওয়াটা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরে। এ দেশের মাটি, আমাদের ভূখণ্ড, আমাদের পতাকার সঙ্গে আছে আমাদের সংস্কৃতির যোগ। আমাদের নিজেদের গান ও কবিতা রয়েছে। চিত্র রয়েছে, পাখির কলকাকলি, কত রঙের ফুল রয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির খনি পড়ে আছে এখানে। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ধরনের গান, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে। গ্রামের পথেপ্রান্তরে চোখ রাখলেই দেখা যায় বেহালা, সারেঙ্গিসহ কিছু না কিছু দিয়ে গান হচ্ছে। তারা কিন্তু চর্চার মধ্যেই আছে। শ্রোতারা তা মন দিয়ে শোনেন। অনেক সময় তা পেশা ও উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। সব কাজেই সংস্কৃতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল খুব সমৃদ্ধ। 

গ্রামের বাউলরা অদ্ভুত সুন্দর গান লিখতে পারেন, মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তা আজও বড় অবহেলিত। 
আমরা যারা শহরে নাট্যচর্চা কিংবা অন্যান্য কাজকর্মের মধ্যে আছি তারাও বেশ যুদ্ধ করেই টিকে আছি। এই জায়গায় সংস্কৃতির সঙ্গে শিক্ষার যোগটা খুব জরুরি, আর সংস্কৃতির শিক্ষাটা খুব প্রয়োজন। এখনকার দুনিয়াতে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা একজন বিজ্ঞানী বা একজন সাংবাদিককে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হয়, পড়তে হয়। সমগ্র বিশ্বের খোঁজখবর রাখতে হয়। আজ পুরো বিশ্বই সংযুক্ত; কিন্তু আমরা খুব কম নিতে পেরেছি। আমাদের এখানে কম সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাংস্কৃতিক বন্ধ্যত্বের ক্ষেত্রে আগের সরকারে কিছু গাফিলতি ছিল। সিনেমা বা থিয়েটার মুক্ত পরিবেশ দাবি করে। এটি করা যাবে না, ওটা করা যাবে না করলে এগোনো যায় না; যার ফলে একমুখীনতা তৈরি হয়ে যায়। সেটি থেকে মুক্ত হওয়া দরকার ছিল বলে আমি মনে করি। 
এই সময়ে এসেও বিভেদ-বিভাজন-শত্রুতা দেখছি– এটি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে এটি গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যায়। মানুষ প্রতিবাদ করতেই পারে। তাই বলে হিংসা-হানাহানি-বিদ্বেষ একটি জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার পথে বড় অন্তরায়। ঘৃণা-বিদ্বেষের মধ্যে যদি মনটা একমুখী হয়ে যায় তাহলে মুশকিল। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং সব সময় মঙ্গলমুখী। ভালোর দিকে তার সবসময় আকাঙ্ক্ষা থাকে। এই পঙ্কিলতা, স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতাগুলো যত দ্রুত আমরা ত্যাগ করতে পারব ততবেশি মঙ্গল। এখানে সংস্কৃতির বড় ভূমিকা আছে বলে আমার মনে হয়। শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাটা প্রকৃত শিক্ষা হতে হবে। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা, সাহায্য করা– এসব কিছু মিলিয়ে সমাজ গড়ে ওঠে।
সামাজিক মাধ্যমে আমরা অনেক ধরনের প্রতিবাদ দেখি। প্রতিবাদ আমি করব, কিন্তু তা নোংরা বা খারাপভাবে করা উচিত নয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণাদায়ক একটি গান ছিল ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। ফুল আসলে তো ভালোলাগা। ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করাতো নয়। এখানে ফুল রূপক অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছে। এটি একটি প্রতীক। সৌন্দর্যের প্রতীক। স্বাধীনতার এত বছর পরেও যা প্রত্যাশা ছিল তা আমরা পাইনি। নানা সময়ে একমুখীনতায় ভুগেছি আমরা। যেজন্য পিছিয়ে গেছি। বিগত সরকার বর্তমান প্রজন্মের নাড়ির স্পন্দনটা বুঝতে পারেনি। ছাত্ররা বৈষম্য দেখতে পারেনি বলে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। আমরা যে উন্নয়নের কথা বলি সামগ্রিক অর্থেই সেটি মানুষের জন্য হতে হবে। সব আয়োজন মানবের জন্য। এগিয়ে যাওয়ার জন্য। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। গাছপালা, পশুপাখি ছাড়া কিন্তু আমরা চলতে পারব না। সকাল বেলা যদি পাখির গানে ঘুম ভাঙে তাহলে সুন্দর হয়ে যায় সকালটা। বসন্তে যখন ফুল দেখি মনটা ভালো হয়ে যায়। মানুষের মনমানসিকতা বা ভালোবাসা ভালোলাগার দিকে যে উত্তরণ সেটি হওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে শুধু পাঠক্রমের গৎবাঁধা শিক্ষা নয়। অন্তরের বাইরের শিক্ষাটা জরুরি। শিক্ষা হতে হবে সৃজনশীল, আনন্দের এবং মুক্ত মানসিকতার। মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা মানে শুধু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা নয়, এর মধ্যে বড় এক সাংস্কৃতিক জাগরণও জড়িত রয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরা তা দেখেছি। 
এ প্রজন্মকেও আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। তাদের পথচলাটা মসৃণ নয়, ভালো-মন্দ মিলিয়েই। তবে এটিও বুঝতে হবে ফেসবুকই জীবন নয়; যা দেখছি তা সত‍্য কিনা জানা, প্রশ্ন করা জরুরি। 
আগে সাহিত্য পত্রিকা হতো, দেয়াল পত্রিকা করত তরুণরা। সেগুলো এখন অনুপস্থিত। বর্তমান প্রজন্মের মানবকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা দরকার। মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক বিকাশে সে এগিয়ে যেতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে দেয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সঙ্গে শিক্ষার প্রকৃত অনুভূতি নিয়ে বড় হয়ে ওঠা জরুরি। তরুণদের জন্য এটি বেশি প্রয়োজন। সামাজিকমাধ্যম মানুষকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আমি কী এটির মধ্যেই পড়ে থাকব? প্রযুক্তি ব্যবহার করবচ কিন্তু সেটি হবে পৃথিবী, সমাজ ও মানুষের উন্নয়নের জন্য। প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা উচিত। তরুণদের বই পড়া দরকার। আমি যখন একটি বই পড়ি তখন আমার মধ্যে কল্পনার শক্তি তৈরি হয়। সেটি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। একটি পুকুরে স্নান করার কথা কিংবা জল আনার কথা যখন আমি বইয়ে পড়ি তখন ছোটবেলার পুকুরের দৃশ্য দেখতে পাই। না দেখা থাকলে কল্পনার আশ্রয় নিই। এই যে ক্ষমতা এর সঙ্গে আবিষ্কারও জড়িত। আবিষ্কার মানে হলো, দুইয়ে দুইয়ে চার নয় বা অঙ্ক নয়। পৃথিবীতে যা কিছু আবিষ্কার হয়েছে তা প্রশ্ন আর কল্পনা থেকে হয়েছে। পাখির ওড়াউড়ি দেখে ওড়ার ইচ্ছাটা হয়, যার থেকে বিমান তৈরি হয়। সংস্কৃতির জায়গা কিন্তু এটিই। মাঝে কোথাও জানি আমরা একটু বন্ধ‍্যত্বের মধ্যে আটকে গিয়েছিলাম। বহুজনীনতা থেকে একমুখীনতা হয়েছি। একমুখীনতা আসলে টেকে না। বিদ্বেষ-বিভেদ নয়, সমালোচনা প্রয়োজন এবং ভালোবাসার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শিল্পীকে দিতে হবে তাঁর বলার স্বাধীনতা।
’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান এগিয়ে চলার পথ প্রশস্ত করেছে। তবে আগের মতো যদি বলা হয়; এটি বলা যাবে না, ওটি করা যাবে না; আবার যদি একমুখীনতার দিকে চলে আসি তাহলে ঘেরাটোপের মধ্যেই আটকে যাওয়া হবে। এটি মোটেও সুখকর হবে না। 
আমি সবসময়ই ভীষণ আশাবাদী মানুষ। আমাদের দেশের সম্ভাবনার জায়গা অনেক। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। একজন মানুষের মধ্যে অনেক ধরনের সম্ভাবনা থাকে। তার একটা বিকাশের সম্ভাবনা, সৃজনের সম্ভাবনা আছে। নতুনকে সে দেখতে পারে। কল্পনা থেকেই অনেক কিছু আবিষ্কার ও তৈরি হয়েছে, মানবকল্যাণে যা কাজে লাগছে। তরুণদের সুযোগ যেমন বেশি, প্রতিযোগিতাও বেশি। তরুণ প্রজন্মকে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে বিশ্বকে দেখতে হবে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের সাহায্য করতে হবে। তবে চাপিয়ে দিয়ে নয়– ভালোবাসা, প্রেম, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা আর যুক্তিবোধ দিয়ে। 

নাট্যব্যক্তিত্ব

আরও পড়ুন

×