ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

প্লট বিক্রির টাকা নিয়ে এ কেমন প্রতারণা

প্লট বিক্রির টাকা নিয়ে এ কেমন প্রতারণা

ফাইজান আজিম খান ও ডলি সায়ন্তনী

 হকিকত জাহান হকি 

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ০৬:১২ | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২:৫৩

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানের প্লট বিক্রির টাকা পরিশোধ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনীর স্বামী ফাইজান আজিম খানের বিরুদ্ধে। প্লটের মূল্য ৮৩ লাখ টাকার মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ১০ লাখ টাকা।

বাকি টাকা পরিশোধের জন্য দুই দফায় দুটি ব্যাংকের চারটি চেক দেওয়া হলেও তাদের হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক চারটি ডিজঅনার হয়। 
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, টাকা পরিশোধে উভয় পক্ষের আপসনামা হওয়ার পরও বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হয়নি। মাসুদুর রহমান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তিন কাঠার একটি প্লট কিনেছিলেন। তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেশে এসে প্লটটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।

এর জন্য তিনি তাঁর পূর্বপরিচিত ডলি সায়ন্তনীর স্বামী এম অ্যান্ড এইচ ইনকরপোরেশন প্রপার্টিজ রিটেইলারের মালিক ফাইজান আজিম খানের সঙ্গে কথা বলেন। ফাইজান আজিম প্লটটি বিক্রির জন্য মাসুদুর রহমানের কাছে অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা চান। গত বছর জানুয়ারিতে আমমোক্তারনামা দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, ফাইজান আজিম চালাকি করে আমমোক্তারনামাটি তাঁর ঘনিষ্ঠ মো. সিরাজুল হকের নামে নেন। সিরাজুল হকের শনাক্তকারী হিসাবে স্বাক্ষর করেন ফাইজান। প্লটটির মূল্য বাবদ ৮৩ লাখ টাকা মাসুদুর রহমানকে পরিশোধ করার বিষয়টি উভয়ের মধ্যে চূড়ান্ত হয়। 

এর পর মাসুদুর রহমান গত বছর ২৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। তিনি জর্জিয়ার আটলান্টায় বসবাস করেন। যাওয়ার সময় জমির মূল্য বাবদ প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি ৭৩ লাখ টাকা জমি বিক্রির পর দেবেন বলে ফাইজান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এও বলা হয়, যদি প্লটটি বিক্রি করতে বিলম্ব হয়, তাহলে গত বছরের এপ্রিল অথবা মে মাসের মধ্যে যে কোনোভাবে পুরো টাকা পরিশোধ করবেন। গত বছর এপ্রিলের আগে জমি বিক্রি করলেও বাকি ৭৩ লাখ টাকা পরিশোধ নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন।

মাসুদুর রহমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফাইজানকে ফোন করে টাকা চেয়েছেন। এর পরও টাকা দেওয়া হয়নি। অবশেষে তিনি টাকার জন্য দেশে আসেন গত বছর ১২ এপ্রিল। ফাইজানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ৩২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে সিটি ব্যাংকের দুটি চেক দেন। বাকি টাকা নগদে পরিশোধ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। চেক দুটি মাসুদুর রহমানের ব্র্যাক ব্যাংকের হিসাবে জমা দেওয়া হলে ফাইজানের সিটি ব্যাংকের হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় দুটি চেকই  ডিজঅনার (প্রত্যাখ্যান) হয়। 

চেক ডিজঅনার হওয়ার পর মাসুদুর রহমান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। গুরুতরভাবে অসুস্থ হওয়ায় তাঁকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জমি বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে টাকা পরিশোধ না করা ও চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয় মাসুদুর রহমানের কাছে স্বীকার করেন ফাইজান। পুনরায় চেক দিয়ে জমির মূল্য পরিশোধ করার ব্যাপারে উভয় পক্ষের মধ্যে আপসনামা হয়। পরে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে ফাইজান ও তাঁর স্ত্রী ডলি সায়ন্তনীর ইউসিবিএলের যৌথ হিসাবের দুটি চেক প্রদান করা হয়। তাদের হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় এই চেক দুটিও ডিজঅনার হয়। 
জানা গেছে, সিটি ব্যাংকে ফাইজানের ব্যক্তিগত হিসাব ও ইউসিবিএলে ফাইজান ও ডলি সায়ন্তনীর যৌথ হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকার পরও তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মাসুদুর রহমানকে দুই দফায় চারটি চেক প্রদান করেছিলেন।

দ্বিতীয় পর্যায়ে চেক ডিজঅনার হওয়ার পর ফাইজানের কাছে উকিল নোটিশ পাঠানো হয় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর। এতে বলা হয়, নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে প্লটের পুরো মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তবে এই সময়ের মধ্যেও টাকা পরিশোধ করা হয়নি। অবশেষে মাসুদুর রহমান টাকা আদায়ের জন্য মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। মামলাটি দায়ের করার জন্য মাসুদুর রহমান তাঁর শ্বশুর মো. আবদুল হালিম মিয়াকে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদান করেন। আবদুল হালিম বাদী হয়ে ফাইজানকে আসামি করে গত বছরের ২৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন। তবে এ মামলায় বিচারকাজ শুরু হয়নি।

কে কী বলেন

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা মাসুদুর রহমান অসুস্থ থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর শ্বশুর আবদুল হালিম মিয়া সমকালকে বলেন, ‘মাসুদুর রহমান অসুস্থ। তার চিকিৎসার পর্যাপ্ত টাকা নেই। প্লটটির টাকা না পাওয়া গেলে তার জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলেমেয়েদেরও অর্থাভাবে লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।’ তিনি ফাইজানকে প্রতারক উল্লেখ করে তার কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ১০ লাখ টাকা দেওয়ার পর আর কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।

এ বিষয়ে ফাইজান আজিম সমকালকে বলেন, ‘প্লটের মূল্য বাবদ প্রথমে ১০ লাখ টাকা, তার পর আবার ১০ লাখ, আবার ৫ লাখ টাকা অর্থাৎ মোট ২৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এসব টাকা পরিশোধের লিখিত দলিল আছে। চার মাসের মধ্যে মুনাফাসহ সব টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। কোনো কারণে টাকাটা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।’ সিটি ব্যাংকের দুটি চেক এবং তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর ইউসিবিএলের যৌথ হিসাব থেকে দেওয়া দুটি চেক ডিজঅনার হওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, চেক ডিজঅনার হয়েছে বলেই তারা মামলা করেছেন। প্লটের মূল্য বাবদ মোট ৮০ লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। তবে মাসুদুর রহমানের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্লটের মূল্য বাবদ ৮৩ লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল।

প্লট বিক্রির টাকা পরিশোধ নিয়ে সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনীর বক্তব্য জানার জন্য ফোন করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, ‘এসব ব্যাপারে আপনারা আমাকে কেন ফোন দেন। বিজনেস রিলেটেড আমি কিছু দেখি না। আমার গানের ব্যাপারে কিন্তু সে দেখে না।’ তবে ডিজঅনার হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের দুটি চেক ফাইজান আজিম খান ও ডলি সায়ন্তনীর যৌথ ব্যাংক হিসাব থেকে দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি আরও বলেন, মাসুদুর রহমানকে প্লটের মূল্য বাবদ কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা। 

আরও পড়ুন

×