শ্যামার প্রতিরাতেই দুঃস্বপ্ন হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। আব্বার ফোনে টুংটাং এসএমএসের শব্দ হলেই বুকটা ধক করে ওঠে তার। পরে দেখা যায় সেটা সিম কোম্পানির ম্যাসেজ, একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে।

মেডিকেলে পড়ে শ্যামা। সব ঠিক থাকলে সামনের মে মাসে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, সিলেবাসও শেষ করা ছিল তার। পরীক্ষাকে কখনোই ভয় পেত না সে। অথচ এখন পরীক্ষার নাম শুনেই ভয়। কলেজে না-কি জুম অ্যাপে রিভিশন ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। ক্লাস মিস হচ্ছে- সেটার জন্য অত খারাপ লাগে না, ভয় হচ্ছে পরীক্ষাটা যদি অনলাইনে হয়ে যায়, তাহলে হয়তো তার পরীক্ষায় বসা হবে না। 

শ্যামা টিউশনির টাকা জমায়ে একটা স্মার্টফোন কিনেছিল। হলের ওয়াইফাই দিয়ে নেট চালাতে ভালোই লাগতো। বাবাকে একটা নোকিয়া ফোন কিনে দিছিল হল থেকে তার সাথে কথা বলার জন্য। লকডাউনে যখন মেডিকেল বন্ধ হয়ে শ্যামা বাসায় চলে আসলো। সংসারের টানাটানিতে স্মার্টফোনটা বিক্রি করে দেয় বাবা। দু'জন তো একসাথেই আছে, ফোনের দরকার কী? কিন্তু কে জানতো ফোনটার এমন দরকার পড়বে!

করোনাকে ওদের বস্তির আর কেউ ভয় না পেলেও মেডিকেল কলেজের ছাত্রী শ্যামা বেশ ভয় পায়। ওই যে বলে না, যে বিপদ বোঝে না সেই সাহসী? আব্বাকে নিষেধও করছিল এই সময়ে বাইরে না যেতে। কিন্তু কয়দিন আর না যেয়ে থাকবে? সব মানলেও পেট তো মানে না। শ্যামা দুইটা টিউশনি করাতো, ওদের বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে পড়াতে যাবে কি-না। ওরা বলেছে, 'করোনার সময় বের হইও না। জীবন আগে না পড়ালেখা?' অথচ শ্যামা কিভাবে বলবে, জীবনের জন্যই তার পড়ালেখা!

কয়েকদিন শুনছিল সরকার থেকে না-কি ৫০ লাখ মানুষকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে দেবে, শ্যামা হিসাব কষে দেখলো, ওরাও এই ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে পড়ে। আবেদনও করছিল। কিন্তু এখনো টাকার কোনো নামগন্ধ নাই।

এই টাকাটা না পাওয়াতে শ্যামা খুব অবাক হয়েছিল। তখন বাবা তাকে এই বলে বুঝ দিয়েছিল, তাদের চেয়েও আরো খারাপ অবস্থা মানুষের। যখন আইসিইউতে জায়গা না পেয়ে রহিম চাচা মারা গেল, তখন শ্যামাও শ্যামাও বুঝতে পেরেছিল বিষয়টা। সে অনেক ছোটাছুটি করেছিল চাচাকে নিয়ে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে অক্সিজেনের ব্যবস্থাও করিয়েছিল। কিন্তু শেষদিকে অবস্থা খারাপ হওয়াতে যখন ওনার আইসিইউ আর ভেন্টিলেশনের দরকার হলো, তখন আর শ্যামার সামর্থে কুলালো না। চাচার স্ত্রী ও নয় বছরের মেয়ে- পারলে শ্যামার পায়েও ধরে, কিন্তু তারা কিভাবে বুঝবে আইসিউতে নেওয়ার মতো সামর্থ্য এখন আর এই গরীব মানুষগুলোর নেই।

শ্যামার সবচেয়ে খারাপ লাগছিল যেদিন বাবার শরীরে ব্রুইসের দাগ পায়। বাবাকে জিজ্ঞেস করাতে বলে বয়স হয়েছে তো, ডিভাইডারের সাথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে ছোটখাটো। কিন্তু ফরেনসিক মেডিসিন পড়ায় সে ঠিকই বুঝছে এটা ব্লান্ট ফোর্স মানে লাঠির আঘাত। সব ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন শ্যামার বান্ধবী মিথিলা বলে কোন জায়গায় নাকি লকডাউন ভেঙে রাস্তায় বেরুনোর জন্য দু'জন বয়স্ক লোককে কান ধরায়ে ছবি তুলে ভাইরাল করে দিয়েছে। শুনে আর কান্না থামায়ে রাখতে পারেনি শ্যামা। বারবার ওই জায়গায় নিজের বাবার ছবি ভাসতেছিল…

বাবা দু'দিন বিছানায় পড়ে ছিল। চাচার বাসায় গেছিল কিছুটা সাহায্যের আশায়। শ্যামার প্রবাসী চাচা করোনা টেস্ট করায়েই বিদেশ গেছিল। কিন্তু ওদের দেশে গিয়ে না-কি ধরা পড়ছে রিপোর্ট ভুয়া। সবাইকে একসাথে ফেরত পাঠাইছে। বহু ধার-কর্য করে বিদেশ যেতে হয়, এখন এই সময় দেশে এসে কী করে খাবে? টাকাটা  হাতে থাকলে হয়তো ছোটখাট ব্যবসাও করা যেত। কিন্তু এখন? একটু সাহায্যের আশায় গিয়ে উল্টা সান্ত্বনা দিয়ে আসল। ওই সময় শ্যামার ইচ্ছা হচ্ছিল বিষ খেয়ে মরে গেলে কেমন হয়!! এত ঝামেলাই হতো না আর!

তবে এখন আর সেই দুঃস্বপ্ন দেখছে না শ্যামা। ওর বন্ধুরা টাকা তুলে তাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিছে। ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ডাক্তারদের একটা সংগঠন। বস্তির এক গর্ভবতী নারীর জন্য রক্ত দরকার ছিল, করোনার মধ্যেও মেডিকেলের ক্লাব থেকে জোগাড় করে দিছে। 

অনেকদিন পর ফ্রি জিবি অফার পেয়ে ফেসবুকে ঢুকে দেখলো বৃদ্ধ লোকটাকে কান ধরানো নারীর শাস্তি হয়েছে। জাল করোনা সার্টিফিকেট দেওয়া মানুষগুলোও গ্রেফতার হয়েছে। টুং করে ফেসবুকের নোটিফিকেশনের আওয়াজে দেখলো কে যেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে ডোনেশনের একটা চ্যালেঞ্জে ট্যাগ করেছে, শ্যামাও সাধ্যমতো ডোনেট করে দিছে। এত ঝামেলার মধ্যেও এই মানুষগুলার জন্যই যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা হয়…

লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ইয়েস গ্রুপ আয়োজিত করোনাকালে দুর্নীতি ও প্রতিরোধের গল্প শিরোনামে 'দুর্নীতিবিরোধী গল্প লেখা' প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

বিষয় : গল্প দুর্নীতি বিরোধী গল্প

মন্তব্য করুন