
'তিন কন্যা', 'উঁকি' আর 'নাইওর'-এর মতো লোকজধারার বিস্ময়কর সব চিত্রকর্মের স্রষ্টা তিনি। আবার তার তুলির আঁচড়েই কিনা উঠে এসেছে- 'এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে', 'এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে' আর 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে'র মতো সময়ের সাহসী ও অনুপ্রেরণাময় ছবি। একদিকে স্বদেশের গভীর লোকজমূলে প্রোথিত তিনি, অন্যদিকে উচ্চকিত, প্রতিবাদী সচেতনভাবে। তিনি শিল্পী কামরুল হাসান- বাংলাদেশের চিত্রকলাকে অধিষ্ঠিত করেছেন অনন্য মর্যাদায়। যদিও নিজেকে শিল্পী নয়, বরং 'পটুয়া' পরিচয় দিতেই ভালোবাসতেন।
বাংলাদেশের শিল্পচর্চার এই স্বতন্ত্র প্রাণপুরুষের জন্মশতবার্ষিকী আজ ২ ডিসেম্বর। যার আঁকা ছবি দেখেই বলা যায়, এ তো বাংলার ছবি, বাংলার মানুষের ছবি। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর বাবার কর্মস্থল কলকাতায় জন্ম নেন এই কালজয়ী শিল্পী। যার পুরো নাম আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তার পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের নারেঙ্গা গ্রামে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্পচর্চার রাজনৈতিক. সামাজিক ও ধর্মীয় নানা প্রতিকূলতার ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে ১৯৫০ সালে এখানকার শিল্পীরা আর্ট ইনস্টিটিউটের বাইরে শিল্প আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিলেন 'ঢাকা আর্ট গ্রুপ'। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ গ্রুপের সভাপতি, সম্পাদক ছিলেন কামরুল হাসান।
'গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস'-এ (পরবর্তী সময়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট) কামরুল হাসান ১১ বছরেরও বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ তাকে সব সময়ই সক্রিয় রাখে। ১৯৫২ সালে এদেশে প্রথম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা এই শিল্পী। পূর্ব বাংলায় আধুনিক শিল্পচর্চায় শিল্পীদের নতুন প্রজন্ম তৈরি এবং চিত্রকলার শক্তিশালী ধারা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। সেইসঙ্গে গ্রন্থ প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও নকশায় যোগ করেন স্বকীয় মাত্রা।
কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে মিশে আছে। মৌলিক রং ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। তার চিত্রকর্মে বাংলার সংস্কৃতিজাত নানা উপাদান ও প্রতীকের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে বাংলার নারী, প্রকৃতি ও অলংকার। তিনি কেবল তার রঙে, রেখাতেই নয়- জীবনাচরণ ও সমাজ-রাজনৈতিকতায়ও তীব্রভাবে ছিলেন বাংলাদেশের। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ রয়েছে জীবনের পরতে পরতে। কেবল ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধই নয়, স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও গভীর সম্পৃক্ত এই শিল্পী।
একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের প্রতীকী মুখাবয়বযুক্ত 'এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে' এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় আঁকা 'এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে' দেশের মানুষকে মুক্তির লড়াইয়ে উজ্জীবিত করেছে।
মৃত্যুর আগমুহূর্তে কামরুল হাসান 'জাতীয় কবিতা উৎসব' মঞ্চে বসে আঁকছিলেন তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের কার্টুন, যা পরবর্তী সময়ে 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' শিরোনামে এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বরেণ্য এই শিল্পী।
কামরুল হাসান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা চূড়ান্ত করেন। চিত্রকলায় অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। এসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৯), চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা (১৯৮৪), বাংলা একাডেমি ফেলো (১৯৮৫) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দেশের বাইরে রেঙ্গুন, রাওয়ালপিন্ডি এবং লন্ডনেও একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে তার। ১৯৮৫ সালে তার জন্মদিনে তার বিখ্যাত তৈলচিত্র 'তিন কন্যা' অবলম্বনে ডাকটিকিট প্রকাশ করে তৎকালীন যুগোস্লাভ সরকার। বিদেশ থেকে বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর চিত্রকর্ম অবলম্বনে ডাকটিকিট ছাপানোর ঘটনা এটিই প্রথম।
দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক কামরুল হাসান প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনেই ছিলেন সামনের সারিতে। সকল প্রকার ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি। মানবকল্যাণই ছিল তার আদর্শ।
বাংলাদেশের শিল্পচর্চার এই স্বতন্ত্র প্রাণপুরুষের জন্মশতবার্ষিকী আজ ২ ডিসেম্বর। যার আঁকা ছবি দেখেই বলা যায়, এ তো বাংলার ছবি, বাংলার মানুষের ছবি। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর বাবার কর্মস্থল কলকাতায় জন্ম নেন এই কালজয়ী শিল্পী। যার পুরো নাম আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তার পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের নারেঙ্গা গ্রামে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্পচর্চার রাজনৈতিক. সামাজিক ও ধর্মীয় নানা প্রতিকূলতার ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে ১৯৫০ সালে এখানকার শিল্পীরা আর্ট ইনস্টিটিউটের বাইরে শিল্প আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিলেন 'ঢাকা আর্ট গ্রুপ'। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ গ্রুপের সভাপতি, সম্পাদক ছিলেন কামরুল হাসান।
'গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস'-এ (পরবর্তী সময়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট) কামরুল হাসান ১১ বছরেরও বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ তাকে সব সময়ই সক্রিয় রাখে। ১৯৫২ সালে এদেশে প্রথম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা এই শিল্পী। পূর্ব বাংলায় আধুনিক শিল্পচর্চায় শিল্পীদের নতুন প্রজন্ম তৈরি এবং চিত্রকলার শক্তিশালী ধারা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। সেইসঙ্গে গ্রন্থ প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও নকশায় যোগ করেন স্বকীয় মাত্রা।
কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে মিশে আছে। মৌলিক রং ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। তার চিত্রকর্মে বাংলার সংস্কৃতিজাত নানা উপাদান ও প্রতীকের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে বাংলার নারী, প্রকৃতি ও অলংকার। তিনি কেবল তার রঙে, রেখাতেই নয়- জীবনাচরণ ও সমাজ-রাজনৈতিকতায়ও তীব্রভাবে ছিলেন বাংলাদেশের। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ রয়েছে জীবনের পরতে পরতে। কেবল ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধই নয়, স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও গভীর সম্পৃক্ত এই শিল্পী।
একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের প্রতীকী মুখাবয়বযুক্ত 'এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে' এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় আঁকা 'এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে' দেশের মানুষকে মুক্তির লড়াইয়ে উজ্জীবিত করেছে।
মৃত্যুর আগমুহূর্তে কামরুল হাসান 'জাতীয় কবিতা উৎসব' মঞ্চে বসে আঁকছিলেন তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের কার্টুন, যা পরবর্তী সময়ে 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' শিরোনামে এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বরেণ্য এই শিল্পী।
কামরুল হাসান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা চূড়ান্ত করেন। চিত্রকলায় অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। এসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৯), চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা (১৯৮৪), বাংলা একাডেমি ফেলো (১৯৮৫) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দেশের বাইরে রেঙ্গুন, রাওয়ালপিন্ডি এবং লন্ডনেও একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে তার। ১৯৮৫ সালে তার জন্মদিনে তার বিখ্যাত তৈলচিত্র 'তিন কন্যা' অবলম্বনে ডাকটিকিট প্রকাশ করে তৎকালীন যুগোস্লাভ সরকার। বিদেশ থেকে বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর চিত্রকর্ম অবলম্বনে ডাকটিকিট ছাপানোর ঘটনা এটিই প্রথম।
দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক কামরুল হাসান প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনেই ছিলেন সামনের সারিতে। সকল প্রকার ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি। মানবকল্যাণই ছিল তার আদর্শ।
মন্তব্য করুন