- শিল্পমঞ্চ
- ডুবারচরের আত্মপ্রত্যয়ী মেয়েরা
ডুবারচরের আত্মপ্রত্যয়ী মেয়েরা
-samakal-6301d3a81cc5c.jpg)
সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের পাশাপাশি তা বজায় রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিশোরীদের কার্যকর অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সচেতন কিশোরী তৈরিতে গঠন করা হয়েছে 'কিশোরী ক্লাব'।: ড. মেরী রশীদ, টিম লিডার, বিংস প্রকল্প
শেরপুর সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লি ডুবারচর উজানপাড়া। সম্প্রতি ঢাকা থেকে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যাওয়া হয় প্রত্যন্ত ওই এলাকায়। কথা হয় ডুবারচর উজানপাড়ার সাথী আক্তার, রোজিনা, স্বপ্না, বিলাসী, শারমিন, রিমাসহ আরও কিশোরীর সঙ্গে। এরা সবাই স্থানীয় কামারেরচর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। কেউ অষ্টম, কেউ নবম শ্রেণিতে। আর দশজন প্রান্তিক কিশোরীর সঙ্গে তাদের রয়েছে বিস্তর তফাত। ওদের বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চোখে দেখি আত্মপ্রত্যয়। ওরা জানে নূ্যনতম পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে প্রতিদিনের খাদ্যে কী ধরনের শাকসবজি থাকা দরকার। ওরা জানে মাসিকের কারণে রক্তস্বল্পতা দূরীকরণে আয়রন বা ফলিক ট্যাবলেট খাওয়া কতটা জরুরি; পয়ঃনিস্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা কেন প্রয়োজন; বাল্যবিয়ে কতটা ভয়ংকর। শুধু কি জানে, মোটেও তা নয়; পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণে বাড়ির আঙিনা কিংবা আশপাশে শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করে তারা। ওরা পাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে প্রতি মাসে নিয়মিত বিনামূল্যে একটি করে আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করে। বাল্যবিয়ে রোধে ওরা এর কুফল বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করে। এর পরও কোনো অভিভাবক বাল্যবিয়ে দিতে চাইলে স্থানীয় নেতা-নেত্রী বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে জানিয়ে কিংবা ১০৯ নম্বরে ফোন করে সেটি বন্ধ করতে ভূমিকা রাখে।
ডুবারচর উজানপাড়ায় সাথী, রোজিনা, শারমিনদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। শারমিন জানায়, কিছুদিন আগে পাশের গ্রামের এক কিশোরীর বিয়ে ওরা কীভাবে বন্ধ করেছে। আর রিমা তো নিজের বিয়েই আটকে দিয়েছে! রিমার মা-বাবা তাকে বিয়ে দিতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কেন এ সময়ে বিয়ে করা উচিত নয়, সেটি মা-বাবাকে বোঝাতে সমর্থ হয় রিমা। সে জানায়, 'আমি নিজে যদি বাল্যবিয়ের কুফল না জানতাম তাহলে মা-বাবাকে বোঝাতে পারতাম না, হয়তো আমারও বিয়েটা হয়ে যেত।'
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কীভাবে এতটা সচেতন হয়ে উঠল পাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা এ কিশোরীরা। জানা গেল, 'বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ টু এনহ্যান্স নিউট্রিশন সিকিউরিটি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (বিংস)' শীর্ষক প্রকল্প এই কিশোরীদের জীবন পাল্টে দিতে কাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ান এনজিও কো-অপারেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া সরকারের সহ-অর্থায়নে ওয়ার্ল্ড ভিশনের নেতৃত্বে, উন্নয়ন সংঘ, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-হার্ভেস্টপ্লাস ও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিংস প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মূলত পুষ্টি ঝুঁকিতে থাকা গর্ভবতী নারী, দুগ্ধদানকারী মা, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের পুষ্টিমানের উন্নয়ন এবং পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা, কার্যকরী সমন্বয় ও জবাবদিহির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বিংস প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জামালপুর ও শেরপুর জেলার নির্বাচিত ছয়টি উপজেলার (শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও শেরপুর সদর এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর ও জামালপুর সদর) পুষ্টি ঝুঁকিতে থাকা ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮২৫টি পরিবারের ১৭ লাখেরও বেশি মানুষের পুষ্টিমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, মা ও সেবাদানকারী রয়েছে ৯৩ হাজার ৮৭ জন, ৫০ হাজার ৭৩২ জন গর্ভবতী নারী ও দুগ্ধদানকারী মা, ৪৪ হাজার ৭৩৫ জন কিশোরী।
এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশনের বিংস প্রকল্পের টিম লিডার ড. মেরী রশীদ বলেন, 'মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধিতে পুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিশোরী বয়সে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ না করলে তার ফল সারাজীবন ধরে বহন করতে হয়। এমনকি আজকের যে কিশোরী, আগামী দিনের সে মা। এর প্রভাব তার নবজাতকের ওপরও পড়বে। ফলে একটি সুস্থ জাতি গঠনে কিশোরীর স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।' তিনি আরও বলেন, "সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের পাশাপাশি তা বজায় রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিশোরীদের কার্যকর অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সচেতন কিশোরী তৈরিতে গঠন করা হয়েছে 'কিশোরী ক্লাব'। প্রকল্প থেকে দেওয়া স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষাবিষয়ক বিশেষ লুডু খেলার মাধ্যমেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ইন্টারঅ্যাকটিভ পপুলার থিয়েটার তথা গণসচেতনতামূলক নাটকের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।"
কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শেরপুর ও জামালপুরের নির্বাচিত ১৫ হাজার ৬৮৭ কিশোরীকে নিয়ে ৬৭২টি কিশোরী ক্লাব গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কিশোরী ক্লাবের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণে রয়েছেন একজন কমিউনিটি নিউট্রিশন প্রমোটার। প্রকল্পটি ২২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকে সুশাসন ও সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে এবং এ ক্ষেত্রে সরাসরি কাজ করছেন এই কমিউনিটি নিউট্রিশন প্রমোটাররা।
কার্যক্রমটিকে স্কুলেও নিয়ে গেছে সংস্থাটি। দুটি জেলার ৩৬টি স্কুলের ৭২০ জন স্কুল টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য গঠন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প শুরুর পর ৮৫ হাজার ৩২৫ জন কিশোরী নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করেছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের বিংস প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. জহিরুল হক বলেন, 'পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কী ধরনের বাজেট থাকা প্রয়োজন, তা উল্লেখ করে ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে স্মারকলিপি দিয়েছে ৩৪৮ কিশোরী ক্লাব। এ ক্লাব চালুর পর দেখা যাচ্ছে, যেখানে অন্যান্য কিশোরীর আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণের হার ৭৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, সেখানে কিশোরী ক্লাবের সদস্যদের আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণের হার শতভাগ। অপুষ্টি রোধে কিশোরীরা এখন তাদের বাড়ির আঙিনা কিংবা পাশের পতিত জমিতে রকমারি সবজি ও ফলমূল উৎপাদন করছে।'
পরিবর্তনের হাওয়া ছড়িয়ে দিতে গণসচেতনতামূলক নাটককেও (ইন্টারঅ্যাকটিভ পপুলার থিয়েটার) বেছে নিয়েছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। আর এই নাটকে অভিনয় করছে স্থানীয় কিশোর-কিশোরীই।
শেরপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, 'গ্রামবাংলার মানুষের কাছে যে কোনো বার্তা সহজেই নাটকের মাধ্যমে দেওয়া যায়। নাটকের বিষয়বস্তু তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়।'
মেন কেয়ার অ্যাপ্রোচ
পুষ্টি নিশ্চিতকল্পে বিংস প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে ভাঙতে হবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা অচলায়তন। এ বিষয় তুলে ধরতে বিংস প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে 'মেন কেয়ার' অ্যাপ্রোচ। এর উদ্দেশ্য হলো, সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে পরিবারে সব কাজে নারী-পুরুষ সবার যথাযথ মতামত ও প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ জরুরি।
পরিবারে কোনো কাজ নারী বা পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। সবাই যেন সব কাজ করতে পারেন। এজন্য পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। শুধু কি পরিবারের পুরুষ সদস্যের, পাশাপাশি শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্কও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে মেন কেয়ার উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবারের স্বামী-স্ত্রী-শাশুড়ির মতো সদস্যদের নিয়ে উঠান বৈঠক আয়োজন করা হয়। উঠান বৈঠকে হুজুরা বেগম তাঁর স্বামী, ছেলে ও ছেলের বউসহ অংশ নেন। তিনি জানালেন, আগে পুরুষরা নারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এ প্রবাদ শুনিয়ে দিত- 'বেটি মানুষ ১২ হাত কাপড়ে বেড়ে না, হেগো বুদ্ধি নেওন যাব না।' কিন্তু এখন দিন বদলাইছে। হুজুরা বেগম বলেন, চমৎকার এ আয়োজনে অংশ নিয়ে তাঁর জীবনটাই পাল্টে গেছে। আগে যেটি কল্পনাও করেননি, এখন যে কোনো বিষয়ে পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ির আশপাশে শাকসবজি চাষ করেন। পুষ্টিকর খাবার খান। ছেলে, মেয়ে নাকি ছেলের বউ- এসব বিষয়ে এখন আর পার্থক্য করেন না। প্রতিদিন সবার জন্যই থাকে পুষ্টিকর খাবার।
মন্তব্য করুন